Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

বাধা হাজারো, তবুও ছেদ পড়েনি সিংহবাড়ির পুজোয়

জমিদারি গিয়েছে সেই কবেই। তিন বিঘা জমির বাড়িটিকে দেখলে যে কারওর মনে হবে হানাবাড়ি। পুরো বাড়িটাই ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা। তবুও সেই বাড়িতেই শুরু হয়েচে মায়ের আরাধনা। বাড়ি সারানো না যাক, ভেঙে পড়া ঠাকুর দালান সেজেছে নতুন ভাবে।

রঙ পড়ছে প্রতিমায়।—নিজস্ব চিত্র

রঙ পড়ছে প্রতিমায়।—নিজস্ব চিত্র

বিমান হাজরা
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২৬
Share: Save:

জমিদারি গিয়েছে সেই কবেই। তিন বিঘা জমির বাড়িটিকে দেখলে যে কারওর মনে হবে হানাবাড়ি। পুরো বাড়িটাই ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা। তবুও সেই বাড়িতেই শুরু হয়েচে মায়ের আরাধনা। বাড়ি সারানো না যাক, ভেঙে পড়া ঠাকুর দালান সেজেছে নতুন ভাবে। জমিদারি না থাকলেও কমেনি দুর্গাপুজোর কৌলিন্য। আপন আভিজাত্যের মোড়কে আজও সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা ঘিরে রেখেছে জঙ্গিপুরের জমিদার সিংহ বাড়ির পুজোকে। তাই এই দুর্গাপুজোকে আজও এক নামে চেনে জমিদার সুরি সিংহের পুজো হিসেবে।

কত পুরনো পুজো? সন তারিখের কোনও হিসেব নেই জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের কারওর কাছেই। এক সময় অবশ্য জমিদার বাড়ির ইতিহাসের কথা শোনা যেত পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কাছে, তাঁরা প্রায় সকলেই গত হয়েছেন।

জনশ্রুতি, প্রায় ৩০০ বছর আগে জমিদার চেতিলাল সিংহ এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। তখন ২০ মাইল দূলুুবূিীবরের সাদিকপুর পর্যন্ত জমিদারির বিপুল আয়। তা দিয়েই দুর্গা পুজোর বিশাল আড়ম্বর দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যেত সকলেরই। পুজোর বাজেট বলে কিছু নির্দিষ্ট থাকত না। পুজোর সময় কোথাও থেকে আসত সবজি, চাল, ডাল। আবার কোথাও থেকে বাড়ির উঠোনে ঝুড়ি বোঝাই মাছ আসত কেউ খবর রাখত না তার। কত লোককে কে কোথায় নিমন্ত্রণ করেছে, সে সবেরও বাঁধা ধরা ফিরিস্তি রাখত না কেউই। রাখার প্রয়োজনও পড়ত না।

পরিবারের শেষ জমিদার সুরেন্দ্র নারায়ণ সিংহের পুত্রবধূ অলোক সিংহ সেই ১৭ বছর বয়সে এই সিংহ বাড়িতে এসেছিলেন।

তাঁর কথায়, “শ্বশুর বাড়ির পুজোর এই আড়ম্বর দেখে প্রথম প্রথম ভয় হত। ভাসুর, দেওর মিলিয়ে পাঁচ ভাইয়ের বিশাল সংসার। বহিরাগতদের আগমনে জমজমাট থাকত নাট মন্দির। পুজোর ক'দিন নিঃশ্বাস ফেলার জো থাকত না।

আর আজ!

দীর্ঘ শ্বাস ঝরে পড়ে অলোকদেবীর গলায়, “সেই জৌলুস আর কই? লোক লস্কর ও আড়ম্বরেও টান পড়েছে। কিন্তু আভিজাত্য ও সম্ভ্রমে এই পুজো আজও সমীহ পায় জঙ্গিপুরে। এক সময় অনেকটাই আভিজাত্যের বন্ধনে বাঁধা ছিলাম আমরা। বাড়ির বাইরে ঠাকুর দালান পেরোবারও হুকুম ছিল না। বাড়ির পুজো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, শহরের পুজোগুলোও আর ঘুরে দেখা হত না ।

অলোকদেবী জানান, আগে হাতে গোনা প্রতিমা হত শহরে। শহরের প্রতিমাগুলি বিসর্জনের আগে জমায়েত হত জমিদারবাড়ির নাটমন্দিরে। সেখানে চলত মেহফিল। শেষে সিংহ বাড়ির পরে একে একে ভাগীরথীতে বিসর্জন হত প্রতিমাগুলি।

আর পাঁচটা পুজোর সঙ্গে কোনও তফাত নেই জমিদার বাড়ির এই পুজোর। তফাত শুধু সপ্তমীর রাতে “মহানিশি পুজো” নামে এক বিশেষ পুজোর আয়োজন হয় এই জমিদার বাড়ির পুজোয়।

তবে আগের মত বেহিসেবি বাজেটের পুজোর রমরমা আর নেই সিংহ বাড়িতে। জানালেন পুজোর অন্যতম আয়োজক রবিশঙ্কর সিংহ। পুজোর প্রায় সব খরচটাই আসে বাড়ির পাশেই বিঘে তিনেকের জমিদারদের নিজস্ব তহবাজারের আয় থেকে।

পেশাগত ভাবে এখন সিংহ বাড়ির সদস্যরা কেউ চাকরি করেন, কেউবা ঠিকাদারি। তবে বাধা বিঘ্ন যাই এসেছে কখনও ছেদ পরেনি বাড়ির দুর্গা পুজোয়। ২০০৩ সালেই ঘটে অঘটন। অলোকদেবীর স্বামী কানাই লাল সিংহ প্রতিবারের মত সপ্তমীর সকালে পাশেই ভাগীরথী নদিতে যান ঘট ভরতে। প্রথামত নদীতে স্নান সেরে এক সঙ্গে জল ভরা ঘট নিয়ে ফেরেন পরিবারের সকলে। কিন্তু, নদীতে ডুব দিয়ে আর উঠতে পারেন নি সিংহ বাড়ির কর্তা ৭৩ বছরের কানাইবাবু। পরে নদীর জল থেকেই উদ্ধার হয় তাঁর মৃতদেহ। এই শোকবহ ঘটনার পরেও ছেদ পড়েনি সিংহ বাড়ির দুর্গা পুজোয়। পুরোহিতের নামে সংকল্প করে সম্পন্ন হয় সে বারের পুজো। তবে এখন আর মেহফিল বসে না সিংহ বাড়ির ঠাকুর দালানে। লোক লস্করে ভাটা পড়েছে অনেকটাই। “তবু পুজোটা তো বন্ধ করা যাই না, তাই চলছে এখনও। অন্ততঃ আমি যতদিন আছি।” বলছেন অলোকদেবী ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE