স্বাদ একই আছে। কুলোচ্ছে না সাধ্যে।
আর সেই কারণে শেষ অগ্রহায়ণেও নলেন গুড় নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছেন ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েই। নোট বাতিলের গেরোয় গুড়ের কারবারিদের গলাতে স্পষ্ট হতাশা, ‘‘আয়োজনই সার। লাভের গুড় যে এ ভাবে নোটে খাবে কে জানত!’’ আর ক্রেতারা বলছেন, ‘‘দাঁড়ান মশাই, আগে চাল-ডালের ব্যবস্থা করি। তারপরে না হয় নলেন গুড় নিয়ে ভাবা যাবে।’’
বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মাজদিয়া হাটের খেজুর গুড়ের বেশ চাহিদা আছে। বছর কয়েক থেকে এই এলাকার নলেন গুড় টিউববন্দি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকী বিশ্ব বাংলার স্টলে বিক্রি হওয়া টিউববন্দি সেই গুড়ে মজেছিলেন বিদেশিরাও। এ বার?
কারবারিরা জানাচ্ছেন, বিদেশ তো দূরের কথা, এ দেশের মানুষও সেই গুড় চাখতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। টিউববন্দি এই গুড় ভিন্ দেশেও রপ্তানি করতে উদ্যোগী হয়েছিল খাদি বোর্ড। কিন্ত এমন অবস্থায় সেই পরিকল্পনাও বিশ বাঁও জলে।
কারণ গত কয়েক দিন ধরে মাজদিয়ায় গুড় উৎপাদন বন্ধ। খাদি দফতর থেকে টিউববন্দি নলেন গুড় সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছেন মাজদিয়ার অশোক হালদার। কিন্তু এ বার তাঁকে বহু শিউলি রস দিচ্ছেন না। জ্বালানী কাঠ পেতেও তাঁকে নানা কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। শিউলি ও কাঠ ব্যবসায়ীদের দাবি, মাজদিয়ার ওই ব্যবসায়ী লক্ষাধিক টাকার রস ও কাঠ নিয়ে টাকা দিচ্ছেন না।
অশোকবাবু বলছেন, ‘‘কী করে টাকা দেব বলুন তো? সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি তুলতে পারছি না। অথচ আমার দৈনিক কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকার প্রয়োজন। সে টাকা না পাওয়ায় শিউলি ও কাঠ ব্যবসায়ীদের টাকা দিতে পারছি না। তাঁরাও বাকিতে জিনিস দিচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রেখেছি। এমন অবস্থায় এক লক্ষ টিউব গুড় সরবরাহ তো দূরের কথা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারব না।”
পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামোন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “টিউববন্দি গুড় এ বার বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নোট বাতিলের ধাক্কায় সব এলোমেলো হয়ে গেল।”
মাজদিয়ায় ফি রবিবার বসে গুড়ের হাট। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। নৈহাটির বাসিন্দা বছর সত্তরের অমরচন্দ্র সাহা বলছেন, ‘‘৫০ বছর হয়ে গেল এই গুড়ের হাটে আসছি। কালে কালে কত কিছুর ওঠা-পড়া দেখলাম। কিন্তু, নোটের ধাক্কায় এ ভাবে ব্যবসা চৌপাট হতে কখনও দেখিনি। হাটে এসে প্রায়ই খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।’’
বহরমপুরের হাতিনগরের নলেন গুড়ের ব্যবসায়ী দিলীপ সাহা বলছেন, ‘‘একে মানুষের হাতে টাকা নেই। যা আছে তার বেশিরভাগ দু’হাজার টাকার নোট। খুচরো নোটের কারণে সবাইকেই ফল ভুগতে হচ্ছে।’’
হরিহরপাড়ার সলুয়া গ্রামের শিউলি নুর মহম্মদ বলেন, ‘‘প্রতি বার ৮টা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। এ বারেও সেই ৮টি গাছকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাজারের বেহাল দশা দেখে ৩টি গাছ থেকে রস নামাচ্ছি। বাকি ৫টিতে এখনও কলসিই ঝোলাইনি।’’
তথ্য: সুপ্রকাশ মণ্ডল, সুস্মিত হালদার ও অনল আবেদিন