Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আটকে পড়েছি যেন দ্বীপেই

কেরলের বন্যার ধরনটাও কেমন আলাদা। এখানে নদীতে মারাত্মক স্রোত। দেখে বুক কাঁপছিল।

জমির শেখের অপেক্ষায় তাঁর স্ত্রী আজমিরা বিবি। —নিজস্ব চিত্র।

জমির শেখের অপেক্ষায় তাঁর স্ত্রী আজমিরা বিবি। —নিজস্ব চিত্র।

জমির শেখ
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০২:০২
Share: Save:

বন্যা যে আমি এই প্রথম দেখলাম, এমন নয়। আমার বাড়ি শান্তিপুরের বাগআঁচড়া কুতুবপুরে। সেখানে ২০০০ সালে খুব বন্যা হয়েছিল। মাঠঘাট সব ডুবে গিয়েছিল। ফসল কিচ্ছুটি ঘরে তুলতে পারিনি। তবে এ বার বিদেশ-বিভুঁইয়ে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কেরলের বন্যার ধরনটাও কেমন আলাদা। এখানে নদীতে মারাত্মক স্রোত। দেখে বুক কাঁপছিল।

পাঁচ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে কেরলে এসেছিলাম রাজমিস্ত্রির কাজ করতে। এখানে আমাদের গ্রামের অনেকেই রয়েছেন। তবে সবাই এক জায়গায় কাজ করেন না। আমি এখন মলপ্পুরমে আছি। বছরে দু’বার বাড়ি যাই। মাস দুই আগেই ঘুরে এসেছি। গত সপ্তাহে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সে কী বৃষ্টির তোড়! আমাদের কাজ বন্ধ হয়েছিল। ঠিকাদারের ঘরেই ছিলাম আমরা পাঁচ জন। এলাকাটা তুলনায় উঁচু। তাই জল ঢুকতে একটু দেরি হয়েছে। তত ক্ষণে বন্ধু-পরিচিতদের অনেকেই ফোনে জানাচ্ছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় জলে আটকে পড়েছেন। জল ক্রমশ বাড়ছে। গত বুধবার, আমাদের এলাকাতেও জল ঢুকতে শুরু করে। এক তলার অনেকটাই জলের তলায় চলে গেল দেখতে-দেখতে। প্রাণ বাঁচাতে আমরা পাঁচ জন বাড়ির ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।

ছাদ থেকে প্রতি মুহূর্তে দেখতাম, জল বেড়ে চলেছে। আশপাশে যত দূর চোখ যায়, শুধু জল আর জল! ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো সেই জলের আওয়াজ। মনে হচ্ছিল, আমরা একটা দ্বীপে রয়েছি, যেটা কিছু ক্ষণের মধ্যে স্রোতে তলিয়ে যাবে। ভিনরাজ্যে এ কী ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মধ্যে এসে পড়লাম! বৃষ্টিও থামছে না, জলের স্রোতেরও শেষ নেই। চোখের সামনে বাড়ির লোকেদের মুখ ভেসে উঠত। ফোনে কখনো নেটওয়ার্ক থাকে, আবার কখনও থাকে না। যখন বিদ্যুৎ আসে তখন চার্জ দিয়েনি। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলি। আবার এমনও হয় যে, টানা দু’দিন বিদ্যুৎ নেই, ফোনও চার্জের অভাবে বন্ধ। মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় ফেরা হবেনা। স্ত্রীকে বলে রেখেছিলাম, ফোনে লাইন না-পেলে যেন চিন্তা না করে। সময় সুযোগ মতো ফোন করব।

আকাশ অন্ধকার, ঘরে বেশিরভাগ সময় লাইট নেই। পকেটে সামান্য পয়সা, রান্নাঘরে অল্প খাবার। এই ভাবে আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। তার পর বৃষ্টি একটু কমল। জলও নামতে শুরু করেছে এখন। জানি না অবশ্য আবার বৃষ্টি শুরু হলে কী হবে! রবিবার ঠিকাদারের ঘর ছেড়ে নিজেদের ভাড়াবাড়িতে চলে এসেছি। তবে এক তলায় এখনও জল জমে রয়েছে। আমরা দোতলায় রয়েছি। এখানে কোনও খাবার নেই। কখন, কী ভাবে, কোথায় খাবার কিনতে যাব, জানি না।

মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। ইদে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তা আর হল না। কাজ বন্ধ, হাতে টাকা-পয়সাও নেই। এখানে যা অবস্থা তাতে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরুও হবে না। আর এই জলের মধ্যে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরাও কঠিন। আপাতত এখানেই থাকব ভেবেছি। জল নামুক, কাজ আবার শুরু হোক। একটু টাকা-পয়সা জমিয়ে তবে বাড়ি ফিরব। বাড়ির সকলের জন্য খুব মন কেমন করছে। কিন্তু উপায় নেই। প্রাণে বেঁচে রয়েছি এই ঢের!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kerala flood Kerala কেরল
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE