বন্ধ লাইব্রেরি। —নিজস্ব চিত্র।
মোট জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশের বয়স ছয় বছরেরও কম। দশ বা তার কম বয়সীদের সংখ্যাটা প্রায় ত্রিশ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ শতাব্দীপ্রাচীন শহরে তাদের মনোরঞ্জনের কথা ভাবেননি কেউ। তাই ১০.২৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা ধুলিয়ান শহরে শিশুদের খেলাধুলোর জন্য কোনও পার্ক নেই!
একই মনোকষ্টে ভুগছেন বড়রাও। স্কুলশিক্ষিকা থেকে রাজনীতিক, সমাজকর্মী থেকে পুরকর্তা সকলেই এক বাক্যে মানছেন শতবর্ষ প্রাচীন এই শহরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বলে কিছু নেই। সাংস্কৃতিক মঞ্চ বা ভবন কোনওটাই গড়ে ওঠেনি শহরে। কমিউনিটি হলের বালাই নেই। দীর্ঘদিন ধরে তালাবন্ধ শহরে একমাত্র সরকারি গ্রন্থাগার —‘ধুলিয়ান টাউন লাইব্রেরি’। সব মিলিয়ে শহর ধুলিয়ান এখন যেন নেই রাজ্যের প্রতিনিধি!
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ধুলিয়ানে শহরে ছ’বছর বয়সীদের বা তারও নীচের সংখ্যাটা ১৮.৪৭ শতাংশ। ১০ বছর পর্যন্ত সেই সংখ্যা প্রায় ২৯ শতাংশ। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। শহরের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যেখানে শিশু সেখানে তাদের জন্য কোনও খেলাধুলোর জায়গা নেই। দু’একটা খেলার মাঠ যদিও বা রয়েছে তা বড়দের জন্য। তাই বহুতলগুলোর নিজস্ব মাঠে শিশুরা যদিও বা একটুআধটু খেলাধুলোর সুযোগ পায়, শহরের অধিকাংশ পরিবার নিম্নবিত্ত পরিবার হওয়ায় সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে খেলাধুলো অলীক বস্তু হিসেবে থেকে যায়।
প্রাথমিক বিদ্যালেয়র শিক্ষক সুজিত মুন্সি বলেন, ‘‘মানসিক বিকাশের জন্যই শিশুদের কাছে খেলাধুলো, বিনোদন পৌঁছে দেওয়া দরকার। রাজ্যের এমন কোনও শহর পাবেন না যেখানে শিশুদের জন্য পার্ক বা উদ্যান নেই। কিন্তু ধুলিয়ানে ১০ বছর বা তার কম বয়সী প্রায় ৩০ হাজার শিশুর শৈশবকে নিয়ে কেউ ভাবেননি। তাই শহরে কোথাও একটা পার্ক নেই।’’
এক সময় কাঞ্চলতলা হাইস্কুলের পাশে শিশুদের জন্য একটি পার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই কাজ থমকে যায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাসানুজ্জামান বলেন, ‘‘শহরের উন্নয়নের দায়িত্ব পালনে পুরসভা সে ভাবে উদ্যোগী নয়। তাই শিশুদের জন্য পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়েও তা থমকে যায়। সেই জমি এখন পুরসভার আবর্জনার ভ্যাট। এ শহরে প্রতিবাদী মুখের বড় অভাব। তাই সব দেখেও সবাই চুপ।’’
আগ্রহ নেই অভিভাবকদেরও। ধুলিয়ান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী সরকার জানান, সম্প্রতি স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে গিয়ে দেখেন পড়ুয়াদের অনেকের মধ্যেই প্রতিভা রয়েছে। তাই তিনি উদ্যোগ নেন স্কুল ভবনেই সপ্তাহে দু’দিন করে উত্সাহী পড়ুয়াদের নিয়ে নাচগান, নাটক, আবৃত্তির প্রশিক্ষণ চালু করার।
তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েরাও খুব আগ্রহী ছিল। কিন্তু অভিভাবকের একাংশের বাধায় তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।’’ বাণীচাঁদ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা জ্যোতিরূপা বিশ্বাস বলেন, ‘সাংস্কৃতিক মনস্কতা হঠাৎ করে তা গড়ে ওঠে না। পরিবার অন্যদের থেকে সাহস, উৎসাহ পেয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু তেমন ছেলেমেয়ে মিলছে কই। তাই স্কুলগুলি নিয়মরক্ষার অনুষ্ঠানের বাইরে বেরোতে পারছে না।’’
অন্য দিকে, ধুলিয়ান শহরের একমাত্র সরকারি গ্রন্থাগার তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে এক বছর থেকে। ১৯৫৭ সালে ‘পল্লিকল্যাণ গান্ধী আশ্রম লাইব্রেরি’ই পর শহর গ্রন্থাগার হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পায় ওই গ্রন্থাগার। শেষ গ্রন্থাগারিক অবসর নিয়েছেন ২০১৩ সালের অগস্ট মাসে। তারপর গ্রন্থাগারের ঝাঁপ খুলে রেখেছিলেন নৈশপ্রহরী সত্যরঞ্জন দাস। তিনিও অবসর নিয়েছেন গত বছর অক্টোবরে। সেই থেকে তালাবন্ধ গ্রন্থাগারটি। গ্রন্থাগারের সম্পাদক রজত রায় বলছেন, ‘‘রোজ গড়ে ৪০ জন করে পাঠক আসতেন। প্রায় ১৪ হাজার বই রয়েছে। এর মধ্যে বহু বই-ই দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু বহুবার গ্রন্থাগার দফতরকে জানিয়েও গ্রন্থাগারের তালা খোলা যায়নি।’’
ধুলিয়ানে দু’দুটি মুক্তমঞ্চ রয়েছে। একটি কাঞ্চনতলা হাইস্কুলে। একটি ইলেভেন স্টার ক্লাবে। ক্লাবের মঞ্চ উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা বিধায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়। সেই মঞ্চের সামনের দর্শকাসন এখন আগাছার জঙ্গলে ভরা, সাইকেল-রিকশার গ্যারাজে পরিণত হয়েছে। কাঞ্চনতলা স্কুলের মুক্ত মঞ্চ কার্যত ছাত্রদের সাইকেল স্ট্যান্ড। তার ব্যবহার হয় স্কুলের অনুষ্ঠানে বছরে দু’একদিন। অথচ এই স্কুলেরই নিম্নবিত্ত পরিবারের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাসুম মোমিন কলকাতায় রাজ্যস্তরে নামী এক সংস্থার অঙ্কন প্রতিযোগিতায় দু’বছরে দু’দুবার পুরস্কার জিতে এনেছে। তাই সুযোগ থাকলে অন্য পড়ুয়ারও যে প্রতিভার প্রকাশের সুযোগ পেত তা মানছেন সকলে।
শহরের এক নাট্য সংস্থার কর্ণধার কল্যাণ গুপ্ত বলেন, ‘‘আগে বছরে তিন দিন ধরে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হত। কিন্তু শহরে মঞ্চ বলে কিছু নেই। তাই বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী মণ্ডপ করে অনুষ্ঠান করা হয়। এখন সেটুকুও কষ্টকর হয়ে উঠেছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘তার চেয়েও বড় সমস্যা নাটকের কুশিলব পাওয়া। মহিলাদের তো বাদই দিলাম, তরুণদের মধ্যেও নাটক নিয়ে কোনও উত্সাহ নেই। শহরে এতগুলো স্কুল, কিন্তু সেখানে সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার কোনও চেষ্টাই নেই!’’
প্রাক্তন শিক্ষক প্রভাত কুণ্ডু নিজে ধুলিয়ান শহরের প্রাচীন ক্লাব শহিদ নলিনী ভ্রাতৃ সঙ্ঘের সভাপতি। এক সময় তার হাত ধরে শহরের বুকে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড অন্য মাত্রা পেয়েছিল। আজ তাঁর মুখে বিলাপের সুর। তিনি জানান, বিপ্লবী নলিনী বাগচি জন্মেছিলেন এই শহরেই। প্রায় ১২ বছর এই শহরে কাটিয়েছেন। পড়াশুনোর শুরু ধুলিয়ানেরই কাঞ্চনতলা স্কুলে। কিন্তু আজ ধুলিয়ান শহরের কতজন জানেন তাঁর নাম।’’
পুরপ্রধান সুবল সাহা বলেন, ‘‘ঘনবসতিপূর্ণ ধুলিয়ানে জমিই পাওয়াই প্রধান সমস্যা। ইলেভেন স্টার ক্লাবের পাশে জমি থাকলেও তা শিশু পার্কের উপযোগী নয়। তবে কোনও স্কুল ও ক্লাব জমির ব্যবস্থা করে দিলে সেখানে শিশুদের জন্য পার্ক গড়তে উদ্যোগ নেবে পুরসভা।’’ ‘‘শহরে দরকার বাসস্ট্যান্ডেরও। শহরে ঢোকার মুখে রাজ্য পূর্ত দফতরের একটি জমি রয়েছে। সরকারের কাছ থেকে নিয়ে সেই জমিতে বাসস্ট্যান্ড গড়ার চিন্তা ভাবনা চলছে।’’—আশ্বাস পুরপ্রধানের।
এখন সেই আশ্বাস-আলোচনার পর্ব পেরিয়ে কবে তা বাস্তবে পরিণত হয় তারই অপেক্ষায় দিন গুনছে শহর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy