প্রতীকী ছবি।
রাতে কারও প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলে প্রথমে খবর দিতে হয় বিএসএফকে। সে খবর যায় এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে। সেখানে সবুজ সঙ্কেত মিললে তবেই খোলে কাঁটাতারের গায়ে লোহার গেট। হোগলবেড়িয়ার চরমেঘনা থেকে নিকটবর্তী করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। বিএসএফের গাড়িতে সেই প্রসূতি হাসপাতালে আসেন। সেখানে যদি শুনতে হয় ‘সিজার কেস’, ছুটতে হবে করিমপুর থেকে আরও প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে।
প্রসূতি তো বটেই, তাঁর সঙ্গের লোকজনেরাও এই দীর্ঘ পথ ছুটতে গিয়ে হাঁফিয়ে পড়েছেন। এ বার সেখানে গিয়ে চিকিৎসার বদলে যদি জোটে চিকিৎসকের দুর্ব্যবহার? কিংবা যদি শুনতে হয়, ‘নর্মাল ডেলিভারির জন্য এখানে কেন? ওটা তো করিমপুরেই হতে পারত।’ তাহলে পরিস্থিতিটা ঠিক কেমন দাঁড়ায়?
নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে এমন বহু ঘটনার নজির আছে। করিমপুরের অভয়পুরের এক তরুণী প্রথমে করিমপুর, সেখান থেকে কৃষ্ণনগর সদর, ফের সেখান থেকে করিমপুরে ফিরে আসেন। করিমপুরের হাসপাতালের চিকিৎসক আবার যখন তাঁকে কৃষ্ণনগরে যাওয়ার কথা বলেন, জেদ ধরে বসেন ওই তরুণী। তিনি বলেন, ‘‘যা হওয়ার এখানেই হবে।’’ শেষতক করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালেই তিনি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন।
তা হলে এই হয়রান কেন? জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘আসলে অশান্তির ভয়ে বহু চিকিৎসক ঝুঁকি নিতে চান না। আর সেই কারণেই সামান্য কোনও সমস্যা থাকলে অনেকেই রেফার করে দেন।’’ তিনিও মানছেন, ‘‘এটা অবশ্য সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু সামান্য কিছু ঘটলে রোগীর বাড়ির লোকজন যে ভাবে মারমুখি হয়ে উঠছেন তাতে চিকিৎসকেরাও উভয় সঙ্কটে পড়ছেন।’’
অথচ বছর কয়েক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। বরং লোকজন সবথেকে বেশি ভরসা করতেন চিকিৎসকদের। দীর্ঘ দিন শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের সুপার ছিলেন রমেন্দ্রনাথ সরকার। কাছ থেকে দেখেছেন বহু চিকিৎসকদের। তিনি বলেন, “আসলে এটা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। এখন অনেকেই ডাক্তারি নয়, চাকরি করতে আসেন। এই পেশাটা তো আর পাঁচটা পেশার মতো নয়। ডাক্তাররা তো সব জেনেবুঝেই এই পেশায় আসেন। তা হলে তাঁরা সেটা সামলাতে পারছেন না কেন?”
এত বছর পরেও রমেন্দ্রনাথের মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে কৃষ্ণনগরের অশান্ত পরিবেশের কথা। তিনি জানান, কালীপুজোর ভাসানে শহরের দুই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে গণ্ডগোলে গুরুতর জখম হন বেশ কয়েক জন। তাঁদের নিয়ে হাসপাতালে হাজির দুই ‘দাদা’ আর তাঁদের উন্মত্ত অনুগামীরা। তখন সবে জেলা হাসপাতালে শল্য চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সঞ্জয় হাজরা। একেবারে তরুণ। তিনি কিন্তু ঠান্ডা মাথায় গোটা বিষয়টা সামাল দিলেন। কাউকেই রেফার করলেন না। অথচ এক জনের কিছু হয়ে গেলে চরম বিপদ হতে পারত তার। তিনি কিন্তু সে দিন নিজের বিপদের কথা না ভেবে রোগীদের কথা ভেবেছিলেন। রেফার করলে তিনি চাপমুক্ত হতেন ঠিকই। কিন্তু রাস্তাতে কেউ মারাও যেতে পারতেন। তাঁর কথায়, ‘‘সঞ্জয় একা নন, ওঁর মতো অনেকের কাছে রোগীই আসল। কই, তাঁদের তো কখনও কর্তব্য ভুলে টাকার পিছনে ছুটতে দেখিনি।”
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy