প্রতীকী ছবি।
কাজটা কঠিন কিনা, সেই প্রশ্ন তখন অনেক দূরে। প্রথম প্রথম তাঁরা বুঝতেই পারেননি বিমা মানে আসলে কী। ব্যাঙ্ক কর্তাদের দৌলতে কিছুটা যখন বুঝলেন তখন তাঁদের বিস্ময় কাটতেই সময়ে লেগেছিল বিস্তর। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর প্রশ্ন ছিল, ‘‘এমনটা আবার হয় নাকি? মরে গেলে টাকা, দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হলে ক্ষতিপূরণ!’’ কেউ কেউ অবশ্য কটুক্তি করতেও ছাড়েননি। শুনতে হয়েছিল, ‘‘গরীবের আবার বিমা কিসের?
কিন্তু সব বিস্ময় কাটিয়ে নদিয়া জেলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সদস্যদের বিমা-ব্যবস্থা রীতিমতো দৌড়চ্ছে। সিংহভাগ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য এখন এই প্রকল্পের আওতায়। তাঁদের এই প্রকল্পের পিছনে পুরো সহায়তা অবশ্য কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের। একান্তভাবেই নদিয়ার এই প্রকল্প প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে নাবার্ডেরও। সালটা ২০১০। নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের কী ভাবে বিমার আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন। এ কাজে তাঁরা গ্রাম স্তরের কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতিগুলির সাহায্য পান। একাধিক বৈঠকের পর স্থির হয়, গোষ্ঠীর মহিলারা বছরে ২৫ টাকা করে দেবেন। বছর দুয়েক আগে অবশ্য প্রিমিয়ামের টাকা বেড়ে হয়েছে বছরে ৩০ টাকা। তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের মহিলা উন্নয়ন সেল।
শুরুটা অবশ্য তেমন মসৃণ ছিল না। প্রথম দিকে মাত্র কয়েকশো মহিলা এই বিমা প্রকল্পে নাম লেখান। তবে ছবিটা দ্রুত বদলাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গোষ্ঠীর সদস্যভুক্ত প্রায় সব মহিলাই নিজেদের এই বিমার আওতায় নিয়ে এসেছেন। জেলা সমবায় দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় ৩০,১৭২টি গোষ্ঠী রয়েছে। সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। মহিলারা জানাচ্ছেন, সরকারি স্তরে হয়ত কার্যত নিখরচায় বিমার সুবিধা মেলে। কিন্তু স্বয়ম্ভরের অর্থ হল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তাই তাঁরা সরকারি বিমা প্রকল্পের থেকেও আপন করে নিয়েছেন নিজেদের প্রকল্পকে। সঞ্চয় করছেন সদস্য কল্যাণ তহবিলে। এই তহবিল থেকেই বিমার টাকা জমা হয়।
জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান শিবনাথ চৌধুরী জানান, ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে বিমা বাবদ মহিলাদের প্রায় ১ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। এখনও তহবিলে ৫০ লক্ষ টাকা রয়েছে। দিন কয়েকের মধ্যে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের আয়োজনে মেলা শুরু হবে কৃষ্ণনগরে। সেখানে এই বিমার সুবিধাভোগী কয়েকজন মহিলার হাতে অর্থ তুলে দেওয়া হবে। এই বিমা প্রকল্পের সুবিধা কী? দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও বিমাকারি মহিলার মৃত্যু হলে তাঁর পরিবার ২০,০০০ টাকা পাবেন। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে মিলবে ৩০,০০০ টাকা। অঙ্গহানির ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে ১৫,০০০। স্বামীর মৃত্যু হলে মহিলা পাবেন ১০,০০০ টাকা। কন্যা সন্তান কলেজে পা দিলেই মিলবে এককালীন ১০০০ টাকা। আর স্নাতকোত্তর স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে মিলবে ২০০০ টাকা। দিন কয়েক আগে কৃষ্ণনগর শহর লাগোয়া কালীনগর কলোনি ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটির কয়েকজন মহিলা এই বিমার সুবিধা পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন রিতা মুখোপাধ্যায়। ওই সমবায়ের সদস্য টিঙ্কু মুখোপাধ্যায়ের স্বামী মারা গিয়েছেন মাস খানেক আগে। বিমার টাকা পেয়েছেন তিনিও। ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কালীনগরের বাসন্তী দেবনাথ। দেবগ্রামের আজিরণ বিবি বলেন, মেয়ে কলেজে ভর্তির সময় টাকা পেয়েছিলাম। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য যে এ ভাবে টাকা পাওয়া যায় তা ভাবাই যায় না।
স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা নিজের বিমার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিচ্ছেন। এমন নজির ভূভারতে খুব একটা নেই। গুজরাটের সেবা বিমা প্রকল্প ও দক্ষিণ ভারতে এমন একটা বিমার বন্দোবস্ত রয়েছে। আর তৃতীয়টি রয়েছে নদিয়াতে। নাবার্ড সূত্রে এমনটা জানা যাচ্ছে। বছর কয়েক আগে নদিয়া জেলায় এসে নাবার্ডের তৎকালীন চিফ রেজিস্ট্রার শ্রী এস পদ্মনাভন এই প্রকল্পের ভূয়সি প্রশংসা করে একটি শংসাপত্রও দেন। মুর্শিদাবাদে এমন প্রকল্প না থাকলেও শিগগিরই এমন প্রকল্প শুরু কররতে চলেছে তারা। জেলায় প্রায় ১৭ হাজার গোষ্ঠী রয়েছে। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক অভিজিৎ সরকার জানাচ্ছেন, তাঁরা ভারতীয় জীবন বিমা নিগমের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মহিলাদের বিমার আওতায় আনছেন। আর নদিয়ার মতো তহবিল তৈরির ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে। সমবায় দফতরের সেন্ট্রাল জোনের যুগ্ম নিবন্ধক মহম্মদ ইনাসউদ্দিন বলেন, ‘‘নদিয়া অন্য জেলাকে পথ দেখাচ্ছে। গোষ্ঠীর মহিলারা যে ভাবে বিমার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন, তা প্রশংসার যোগ্য। শীঘ্রই কয়েকটি জেলায় এই মডেল অনুসরণ করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy