যত্ন: বাগান পরিচর্যা। সুতিহাটা প্রাথমিকে। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুলবাড়ির পিছনে ফালি খেতটা দেখলে চমকে উঠতে হয়। মাচায় কচি লাউ, মিড-ডে মিলের খোড়ো চালের উপরে কুমড়ো। দু’পা এগোলেই পুরনো বাঁশের মাচা আঁক়ড়ে পুঁইডাটা। লঙ্কা, বেগুন, পটল, ঢেঁড়শ — কী নেই! খেতের টাটকা আনাজ উঠছে স্কুলের হেঁশেলে। এটা যদি মুর্শিদাবাদের ছবি হয় তা হলে নদিয়ায় ছবিটা এক বার দেখে নেওয়া যাক। মিড-ডে মিলের জন্য নিয়ে আসা আনাজের খোসা, ফ্যান, উদ্বৃত্ত ভাত ফেলে দিচ্ছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। কেন? এক প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক বলছেন, ‘‘ওই দিয়েই জ্বলছে উনুন! স্কুলে জৈবগ্যাস প্রকল্প তৈরি হয়েছে যে।’’
বেশ কিছু স্কুলে খাবারের মান, স্কুলের পঠনপাঠন, শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ তোলাটা যখন প্রায় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্য পথে হেঁটে সা়ড়া ফেলে দিয়েছে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের কিছু স্কুল। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।’’ কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। তেহট্টের অভয়নগর প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার পরেই সফিকুল ইসলামের মনে হয়, প্রায় সব উপকরণই তো হাতের কাছেই রয়েছে। জৈব গ্যাসের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। এক সময় সফিকুল নিজেই ছিলেন নদিয়া জেলা শিল্প কেন্দ্রের জৈব গ্যাস প্রকল্পের ‘মোটিভেটর’। খড়্গপুর আইআইটি থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন তিনি। তা হলে আর দেরি কেন? শিক্ষকেরা নিজেদের টাকাতেই স্কুলে জৈব-গ্যাসের ব্যবস্থা করেন। সফিকুল বলছেন, ‘‘প্রতিদিন ৪০০ টাকার জ্বালানি বাঁচছে। তাতে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছি।”
রানাঘাটের আইশমালি ইউনাইটেড অ্যাকাডেমি স্কুল ‘সোলার ওয়াটার হিটার’-এর ব্যবস্থা করেছে। বছর খানেক রান্নাও হচ্ছে জৈব গ্যাসে। নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জ পানশিলা বালিকা বিদ্যালয়ে দৈনিক ৮০০ ছাত্রী মিড-ডে মিল খায়। সেখানেও ‘সোলার ওয়াটার হিটার’-এর সৌজন্যে মাসে ৪টি সিলিন্ডার কম লাগছে বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। তাহেরপুরের বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, চাকদহের রাজারহাট আর কে এ হাই স্কুলও জৈব গ্যাসেই ভরসা রাখছে। জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের প্রকল্প আধিকারিক সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “কোনও স্কুল যদি জৈব গ্যাস ব্যবহারের উদ্যোগী হয়, আমরা সব রকম ভাবে সহযোগিতা করব।’’
মুর্শিদাবাদের বহু স্কুলের বাগানে আনাজ চাষের কারণে মিড ডে মিলের জন্য বাজারের খরচ অনেক কমে গিয়েছে। আলুটা, মুলোটা, গাজরটা খেত থেকে তুলে আনলেই হল! সালার, বহরমপুর, হরিহরপাড়া, বেলডাঙার একাধিক প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ‘কিচেন গার্ডেন’ করেছে। যে স্কুলে জমির অভাব রয়েছে, সেই সব স্কুল কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের ছাদেই আনাজ ফলাচ্ছেন।
মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক পি উলগানাথন বলছেন, “স্কুলে আনাজ, ফলের বাগান করলে একশো দিনের কাজের প্রকল্প থেকে স্কুলগুলিকে সাহায্য করা হবে।” জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদও চাইছে সব স্কুল এগিয়ে আসুক। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস বৈশ্য বলছেন, ‘‘পড়ুয়াদের পাতে টাটকা সব্জির পাশাপাশি কৃষি সম্পর্কে পড়ুয়াদের উৎসাহিতও করা যাবে।’’ হরিহরপাড়ার ট্যাংরামারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৩ শতক জমিতে আনাজ চাষ হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক অসীম অধিকারী জানান, “মিড-ডে মিলের রান্নার পরে উদ্বৃত্ত আনাজ বিক্রি করে দিই। সেখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে মিড-ডে মিলের পাতে মাংসের ব্যবস্থা করা হয়।’’ একই পথে হাঁটছে বেলডাঙা ১ ব্লকের সুতিঘাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সালারের কান্দরা মিলকিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ও।
পুঁইডাটা, খর্বুটে বেগুন, কড়ে আঙুলের মতো ঢেঁড়শই নয়, সদিচ্ছা থাকলে সোনাও ফলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy