নবদ্বীপ দাপাচ্ছে সারমেয় বাহিনী। — নিজস্ব চিত্র
বেশ ছিল শহরটা। টিমটিমে আলো, জটলা, সদাব্যস্ত শ্মশানঘাট আর নেপথ্যে ভেসে আসা সুর-বেসুরে কীর্তন। নবদ্বীপের এই চেনা, ঝিম ধরা চেহারাটা আচমকা বদলে গিয়েছে মাস কয়েক ধরে।
সেই ছমছমে ব্যাপারটা রয়েছে, তবে কোথায় যেন একটা সুপ্ত ভয় ছড়িয়েছে অলিগলিতে। কীর্তনের সেই চেনা আবহটাও কেটে যাচ্ছে ওদের সময়ে-অসময়ে ঝগড়া-বিবাদ কিংবা সোল্লাসের কোরাসে।
সারমেয় শঙ্কায় ভুগছে মন্দির শহর। গত কয়েক মাসে হই গই করে বেড়ে গিয়েছে পথ-কুকুরের সংখ্যা। আম বাংলায় যার পরিচিতি লেড়ি কুকুর। কলকাতা-শিলিগুড়ি-বহরমপুরের মতো নবদ্বীপও তাদের ওই নামেই চেনে। তবে আর পাঁচটা বড় শহরের মতো তাদের সামাল দেওয়ার মতো আঁটোসাঁটো পরিকাঠামো অবশ্য নেই নবদ্বীপের। শহরের মানুষের ভোগান্তির কারণ সেটাই।
দু-একটা ছোটখাটো উদাহরণেই ছবিটা ফুটে উঠবে আস্ত— দিন কয়েক আগে, রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কীর্তন শুনে বাড়ি ফিরছিলেন মনিপুরের বাসিন্দা প্রবীন দ্বিজেন নাগ সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। পাড়ার মোড়ে কুকুরের জটলা দেখে তেমন আমল দেননি তাঁরা কেউই। দিয়েছিল সারমেয়কুল। তাঁদের দেখেই এক সঙ্গে কোরাস শুশুরু করেছিল তারা। দ্বিজেনবাবু বলছেন, ‘‘বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ জটলা থেকে একটা কুকুর ছিটকে এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গজরাতে থাকল। তার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুট্টে এসে আমার স্ত্রীর হাতে দিল ঘ্যাঁক করে এক কামড়।’’ পাড়া পড়শিরা বেরিয়ে এসে যখন ছাড়াল তখন বাম হাতের কড়ে আঙুলখানা কোনরকমে ঝুলছে। হাতে সংক্রমণ নিয়ে তিনি এখন শক্তিনগরে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর পরের দিনই, হরিতলা ঘোষপাড়ার দুই বাসিন্দা, প্রদীপ এবং প্রসেন ঘোষকে কামড়ায় একটি কুকুর। প্রায় একইরকম প্ররোচনাহীন কামড়।
প্রাচীন মায়াপুর থেকে বিয়েবাড়ির রান্নার কাজ সেরে ফিরছিলেন গীতা দেবনাথ। রাত তখন সাড়ে বারোটা। রানিরচড়া দুর্গাপুজোর মাঠের সামনে দশ-বারোটি কুকুর তাঁকে এবং তার সঙ্গীকে ঘিরে ধরে। তাড়া খেয়ে রাস্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন গীতা। তাঁর সঙ্গী রান্নার বড় হাতা নিয়ে কোন রকমে কুকুরগুলিকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে, লাভ হয়নি। তাঁদের চিৎকারে এলাকার মানুষ বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের উদ্ধার করেন বটে তবে ততক্ষণে কামড়ের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে গীতাদেবীর। সেই তালিকায় রয়েছে, ঠাকুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রার্থনা ঘোষ, ঝর্ণা নাগ, অরবিন্দ দে। তালিকাটা দীর্ঘ।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসেব বলছে, নবদ্বীপের রাস্তা এখন শাসন করছে অন্তত সাড়ে ছ’হাজার কুকুর। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, যাদের মূল ‘কাজ’ই হল পথচলতি মানুষ থেকে বাইক কিংবা সাইকেল আরোহী দেখলেই তাড়া করা। তার পর সুযোগ পেলে কামড়ে দেওয়া।
সেই তালিকায়, পিঠে ব্যাগ স্কুল পড়ুয়া থেকে কীর্তন ফেরত বৃদ্ধ— বাদ যাচ্ছেন না কেউই।
স্থানীয় বাসিন্দা অলখ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘রাতে ফিরি। স্টেশন থেকে নেমে বাড়ি পেরার সময়ে অনেক সময়েই রিকশা পাই না। এখন তো ফেরাটা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ কুকুরের আতঙ্কে আধ কিলোমিটার দূরে বাড়ি ফেরা শিকেয় তুলে দিন কয়েক তাঁকে স্টেশনেই কাটাতে হয়েছে। তাহলে উপায়?
পুরসভার হাতে তেমন কোনও অস্ত্র যে নেই, তা কবুল করছেন পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা। স্পষ্টই জানাচ্ছেন, ‘‘আমাদের পুরসবায় কুকুর ধরার কোনও পরিকাঠামো নেই।’’ সাধারণ ভাবে, পুর এলাকায় রাস্তার কুকুরদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ‘ডগ পাউন্ড’ থাকা দরকার। যেখানে পথ কুকুরদের বছরে এক বার তুলে এনে নিবীর্যকরণ করানো হয়ে থাকে। নবদ্বীপের মতো ছোট শহরে সে ব্যবস্থা নেই। আগামী দিনে তা যে করা যাবে এমন ভরসাও দিতে পারেননি বিনয়বাবু। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে দেবারতি বিশ্বাস বলেন, ‘‘কুকুরদের নিবীর্যকরন ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে নিয়মানুযায়ী কুকুরগুলিকে যে এলাকা থেকে ধরা হয়েছিল, ছেড়ে আসার কথা সেখানেই। বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রিত হলেই এই সমস্য়া অনেকটাই কমে যাবে।’’ কিন্তু সে কথা শুনছে কে?
বিমানবাবু বলছেন, ‘‘পুরসভার এমন কোন পরিকাঠামো নেই যা দিয়ে এখনই পথ কুকুরের সমস্যার সমাধান করা যায়। কথাটা তাই পেড়েছিলাম প্রাণিসম্পদ দফতরের কাছে। আমাদের ওঁরাই ভরসা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy