Advertisement
E-Paper

প্লাস্টিক রুখতে তৈরি শহর, মানুষ পারবে কি

অবশেষে নবদ্বীপ শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিল নবদ্বীপ পুরসভা। সপ্তাহ দুয়েক আগে‌ অগস্ট নবদ্বীপ পুরসভার বোর্ড অব কাউন্সিলরদের বৈঠকে শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঠিক হয়েছে, ৫০ মাইক্রনের কম বেধের নীচে পলিপ্যাক ব্যবহার করলে তা শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫২

অবশেষে নবদ্বীপ শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিল নবদ্বীপ পুরসভা।

সপ্তাহ দুয়েক আগে‌ অগস্ট নবদ্বীপ পুরসভার বোর্ড অব কাউন্সিলরদের বৈঠকে শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ঠিক হয়েছে, ৫০ মাইক্রনের কম বেধের নীচে পলিপ্যাক ব্যবহার করলে তা শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই নির্দেশ কার্যকর হয়েছে।

ঠিক কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা? পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা জানান, নবদ্বীপ শহরের কোথাও ৫০ মাইক্রনের নীচে কোনও পলিপ্যাকে জিনিস বিক্রি করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রথমে মাইকে প্রচার করে ও হ্যান্ডবিল দিয়ে শহরের বাসিন্দাদের জানিয়ে দেব। তার জন্য একটা সময় সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তার পরে কেউ নিয়ম ভাঙলে কঠোর পদক্ষেপ করবে পুরসভা।’’ তবে তাঁর বিশ্বাস, নবদ্বীপের মানুষ প্লাস্টিক বন্ধে বড় উদ্যোগ নেবে।

শহরের বাসিন্দারা যদিও মানছেন, শহরটাকে রাতারাতি প্লাস্টিকমুক্ত করা বেশ কঠিন। খাবারের দোকান থেকে মুদিখানা, সবজি বাজার থেকে মাছ-মাংসের বাজার, তেলেভাজা থেকে জীবনদায়ী ওষুধ— সর্বত্রই প্লাস্টিকের রমরমা। বিয়ের বেনারসি থেকে ত্বকচর্চার তেল-সাবান-শ্যাম্পু এ শহরে সবই বিকোয় সস্তার ফিনফিনে পলিপ্যাকে।

বিপদ কোথায়

১) প্রধান বিপদ, প্লাস্টিক পচনশীল নয় (নন-বায়োডিগ্রেডেবল)। মাটিতে মিশে যায় না। উল্টে ভূগর্ভস্থ জল শোষনের অন্তরায় হয়।

২) রঙিন পলিব্যাগে ‘ডাই-ইথিলিন’ বলে এক ধরনের রাসায়নিক থাকে, যা ওই পলিব্যাগের থাকা খাবারের সঙ্গে মিশে ক্যানসার ঘটাতে পারে।

৩) আগুনে পোড়ানো আরও বিপ্পজনক। পোড়া পলিব্যাগের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যানসার ডেকে আনে।

শুধু তাই নয়, সাতসকালে খালি হাতে বাজারে বেরনো এখন নিত্যদিনের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। পলিব্যাগে শাক-সব্জি-মাছ-মাংস কিনে বাড়ি ফেরাটাই এখন শহরের চালু রেওয়াজ। মোদ্দা কথা এক সময় থলে হাতে বাজারে যাওয়াটা অতীত। আর তার ফলেই বাজারে আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসেছে ফিনফিনে পলিব্যাগ। কিন্তু প্লাস্টিকের এই যথেচ্ছে ব্যবহার তলে তলে গভীর অসুখ বাঁধিয়েছে।

তবে শহর জুড়ে পলিব্যাগের বল্গাহীন ব্যবহার প্রসঙ্গে উদ্বেগ বাড়ছিল নবদ্বীপবাসীর। প্ল্যাস্টিকের ক্যারিব্যাগ গোটা নবদ্বীপ শহরের নিকাশি ব্যবস্থাকে কার্যত বিপর্যস্ত করে তুলেছে। নবদ্বীপ ব্যবসায়ি সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন, “প্রশাসনের তরফে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে যথেচ্ছ ভাবে পলিব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করার এই সিদ্ধান্ত খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। আমরা সহযোগিতা করব।”

শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বছর কুড়ি আগেও ছবিটা এমন ছিল না। একটা সময়ে সব গৃহস্ত বাড়িতেই নানা রকমের ব্যাগ বা থলে থাকত। তার কোনটি কাঁচা বাজার আর মাছ-মাংসের জন্য আলাদা ব্যাগ। আবার মুদিখানার জন্য থাকত আলাদা ব্যাগ। সাদা ক্যাম্বিস, চট এমনকী, বাড়ির পুরোনো কাপড়ের সেই সব থলেই ছিল সেকালের হাট-বাজারের একমাত্র ভরসা।

ছবিটা বদলাতে শুরু করে আটের দশক থেকে। বাজারে এলো নাইলনের ব্যাগ। কৃত্রিম সিনথেটিকের সেই ব্যাগও খুব একটা ক্ষতিকারক হয়ে ওঠেনি। শক্তপোক্ত নাইলনের ব্যাগ বহুদিন ব্যবহার করা যেত, তাকে ধুয়ে সাফও করা যেত। কিন্তু ছবিটা আমূল বদলে গেল পলি ব্যাগের সঙ্গে সঙ্গে। গত দশ বছরে প্লাস্টিকে কার্যত বাজার ছেয়ে গিয়েছে।

পলিব্যাগের বিপদ প্রসঙ্গে বারাসাত রাষ্ট্রীয় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী জানান প্লাস্টিকের ফলে নানা ধরণের বিপদ হতে পারে। তিনি জানান— ১)প্ল্যাস্টিকের প্রধান বিপদ, এটি কোনও অবস্থাতেই পচনশীল নয়। যাকে বলা হয় ‘নন-বায়োডিগ্রেডেবল’। বছরের পর বছর মাটির তলায় থাকলেও মিশে যায় না। উল্টে ভূগর্ভস্থ জল শোষনের প্রধান অন্তরায় হয়ে ওঠে। ২) ৪০ মাইক্রনের পলিব্যাগ ব্যবহারের কথা বলা হলেও হাটে-বাজারে যে ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, তা নিতান্তই ফিনফিনে ৩) রঙিন পলিব্যাগে ‘ডাই-ইথিলিন’ বলে এক ধরনের রাসায়নিক থাকে, যা ওই পলিব্যাগের থাকা মাছ, মাংস, মিষ্টি, তেলেভাজার মতো খাদ্যের সঙ্গে সহজে মিশে মানুষের দেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। ৪) আগুনে পুড়িয়ে পলিব্যাগ নিকেশ করা আরও বিপ্পজনক। পোড়া পলিব্যাগের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্যানসার ডেকে আনে।

তিনি বলেন, “পলিব্যাগের ব্যবহার যারা আমাদের শেখালো, সেই ইওরোপে এখন পলিব্যাগ নিষিদ্ধ। ওদেশে একটা আন্দোলন চালু হয়েছে যার নাম বি ওয়াই বি (bring your bag) অর্থাৎ নিজের ব্যাগ নিজে আনুন। না হলে আপনাকে দোকানদার জিনিসই বিক্রি করবে না।”

নবদ্বীপের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এখানে বেশিরভাগ ক্রেতার মানসিকতা এমন হয়ে গিয়েছে যে, দোকানদার প্লাস্টিক ব্যাগ না দিলে তাঁরা অসন্তুষ্ট হন। এ ব্যাপারে বাজারের সব্জি বিক্রেতা থেকে বড় দোকানের বিক্রেতা সকলের অভিজ্ঞতা এক।

তাঁদের সাফ কথা খরিদ্দার যদি সচেতন না হন, তা হলে আমরা সচেতন হতে গিয়ে ক্রেতাদের বিরাগভাজন হব কেন? তবে শহরের কিছু কিছু দোকান অবশ্য নিজেদের উদ্যোগেই পলিব্যাগ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এজন্য তাঁদের বিক্রি বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং অন্য দোকানে পলিব্যাগের জন্য হম্বিতম্বি করা ক্রেতা এসব দোকানে রীতিমতো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে জিনিস কেনেন। অভ্যাস পরিবর্তন হলেই সমস্যা মিটবে। তবে তার জন্য সময় লাগবে। তবে পুরসভার এই বিষয়ে সদর্থ ক উদ্যোগের প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নবদ্বীপ শহর কড়াইয়ের মতো। এ শহরে এমন অনেক জায়গা আছে যা গঙ্গার থেকেও নিচু। ফলে, সামান্য বর্ষাতেও বন্যার অভিজ্ঞতা আছে নবদ্বীপবাসীর। সে ক্ষেত্রে নিকাশি নালাগুলি সাফ রাখা জরুরি। তিনি বলেন, ‘‘এখন তো শহরের প্রতিটি নিকাশি নালাই পলিব্যাগে ভরে থাকে সব সময়। তা হলে বর্ষার অতিরিক্ত জল বের হবে কী ভাবে? পলিব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রনে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। এটাই সুখের বিষয়।’’

গত এক দশকে নবদ্বীপে বড় বন্যা হয়নি। কিন্তু, এই সময়ে পলিব্যাগের ব্যবহার বেড়েছে দশগুন। যদি বন্যা হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে কি দাঁড়াবে তা অজানা।

রাজ্যের বহু পুরসভা পলিব্যাগের ব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও পর্যটকের শহর নবদ্বীপের পুরসভা এতদিন তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয় নি। দেরিতে হলেও, এ বার সেই উদ্যোগ তারা নিয়েছে।

এবার দেখার, প্লাস্টিক ব্যবহারের অভ্যাস বদলানো যায় কিনা।

Plastic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy