—ফাইল চিত্র।
বাড়ির কাছে ব্যাঙ্ক বলতে ১১ কিলোমিটার দূরে করিমপুর। বছর কয়েক আগে সেখানেই একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন হোগলবেড়িয়ার দুর্লভপুরের অর্পণা ঘোষ। হাজার পাঁচেক টাকা তাঁর খুব দরকার। টানা দু’দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লাইনেও দাঁড়িয়ে থাকার পরে তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘‘টাকা শেষ। কাল আসুন।’’ পরে আরও দু’দিন গিয়েও তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। ক্ষুব্ধ অর্পণা বলছেন, ‘‘নোট বাতিলের গেরোয় এখন এটিএম কিংবা ব্যাঙ্কে এত ভিড় যে, সেখানে গেলেই সারাটা দিন নষ্ট। তা-ও গ্রামে যদি ব্যাঙ্ক থাকত!’’
মুর্শিদাবাদের নির্মল চর থেকে ব্যাঙ্কে যাওয়া আবার আর এক ঝকমারি ব্যাপার। প্রথমে পায়ে হেঁটে কিছু দূর, তারপর নৌকোয় নদী পার হয়ে ফের আর একপ্রস্ত হেঁটে তারপর লছিমন বা টুকটুক ধরে শেখপাড়া ব্যাঙ্ক। এত ঝক্কি সহ্য করে, সারাদিনের কাজ শিকেয় তুলে ১৩ কিলোমিটার দূরের সেই ব্যাঙ্কে টানা তিন দিন ঘুরছেন নির্মল চরের অবিনাশ মণ্ডল। এখনও টাকার দেখা পাননি। অবিনাশ বলছেন, ‘‘আচ্ছে দিন আসার আগে গ্রামে একটা ব্যাঙ্ক আসাটা বেশি জরুরি।’’
কেউ ব্যাঙ্ক থেকে তুলবেন সাকুল্যে তিন হাজার টাকা। কেউ ব্যাঙ্কে এসেছেন পাঁচ হাজার টাকা (পাঁচশো ও এক হাজারের নোট) জমা দেবেন বলে। কিছুটা পথ উজিয়ে এসে দিনভর লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফিরে যাওয়াটাই ওঁদের এখন রোজনামচা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে নদিয়ার ১৮৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩৪টি পঞ্চায়েত এলাকায় কোনও ব্যাঙ্ক নেই। মুর্শিদাবাদেও ২৫৪টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৪১টি পঞ্চায়েতেই কোনও ব্যাঙ্ক নেই। আর সেই কারণে নোট পাল্টানো কিংবা টাকা তুলতে গিয়ে প্রতিদিন চরম ভোগান্তির মুখে পড়ছেন দুই জেলার বহু মানুষ।
নদিয়া ডিস্ট্রিক লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সুগত লাহিড়ি বলছেন, “জেলায় যে সব এলাকায় এখনও ব্যাঙ্ক এখনও খোলা যায়নি সেখানে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক গ্রাহক পরিষেবাকেন্দ্র চালু করেছে। এ বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ব্যাঙ্কহীন গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ব্যাঙ্ক খোলার কথা। তবে নোট বাতিলের জেরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই এলাকায় ব্যাঙ্কের শাখা খোলা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’’ চরগয়েশপুরের পঞ্চায়েত সদস্য জান মহম্মদ শেখের বাড়ি থেকে লালগোলার ব্যাঙ্কের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। টানা তিন দিন সেই পথ পাড়ি দিয়ে সকাল ১০টায় ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা পাননি তিনি। দিনভর অপেক্ষার পরে তাঁকেও শুনতে হয়েছে, ‘‘আজ তো টাকা শেষ!’’ চার দিনের মাথায় তিনি ২০০০ টাকা পেয়েছেন।
মুর্শিদাবাদের লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অমিত সিংহ জানান, জেলায় মোট ব্যাঙ্ক রয়েছে ৩৮০টি। তার মধ্যে সমবায় ব্যাঙ্ক ১৮টি। সমবায় ব্যাঙ্কে বাতিল টাকা জমা দেওয়া, বা বদল করা যাবে না। জেলার ৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কোনও রকম ব্যাঙ্ক পরিষেবা নেই। তবে জেলায় রয়েছে ৮১২টি কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট। সেখানে পরিষেবা দেন ‘ব্যাঙ্ক মিত্র’। সেখানেও টাকা লেনদেন করতে হয় নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। কেমন সেই সীমা? লালগোলার দেওয়ানসরাই অঞ্চলের ‘ব্যাঙ্ক মিত্র’ গোলাম পাঞ্জাতন জানান, কোনও আমানতকারী দিনে ২৫০০ টাকার বেশি বাতিল নোট জমা দিতে পারবে না। এবং তিনি তাঁর অ্যাকউন্টে মোট ৫০ হাজার টাকার বেশি জমা দিতে পারবেন না। ফলে ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে তাঁর অন্তত ২০ দিন লাগবে। আর দিনে তাঁর টাকা তোলার ঊর্ধ্বসীমা ২৫০০ টাকা। কিন্তু টাকার জোগান না থাকায় বর্তমানে ৫০০ টাকার বেশি দেওয়া যাচ্ছে না। অতএব, সেখানেও ভোগান্তিও কম নয়।
ফরাক্কার বাহাদুরপুর ও মহাদেবনগর গ্রাম পঞ্চায়েতে এখনও কোনও ব্যাঙ্ক নেই। ছবিটা একই রকম সুতির মহেশাইল ২ গ্রাম পঞ্চায়েতেও। এনটিপিসি মোড়ে একটি ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে বাহাদুরপুরের কলাইডাঙার বাসিন্দা অরুণা বাস্কে বলছেন, “ডাকঘর আছে পাশের গ্রামে। কিন্তু সেখানে টাকা নেই। ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ফরাক্কার ব্যাঙ্কে আসা মানে সারাটা দিন নষ্ট। তারপরেও টাকা যে মিলবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।’’
মুর্শিদাবাদের লিড ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার অমিত সিংহ বলছেন, ‘‘এপ্রিল মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়, প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ব্যাঙ্কের শাখা খোলার জন্য। রাজ্য সরকার সেই অনুযায়ী গ্রাম পঞ্চায়েতে মাত্র ১ টাকা মাসিক ভাড়ায় জায়গা দেওয়ারও ব্যাবস্থা করেছে। ফলে সমস্ত পঞ্চায়েত এলাকায় রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কের শাখা খোলার চেষ্টা চলছে।’’ সেই চেষ্টার সুফল কবে মিলবে, সে প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।
(তথ্য সহায়তা— বিমান হাজরা ও সুজাউদ্দিন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy