Advertisement
১৭ মে ২০২৪

ভোট-গরমে রক্তশূন্য ব্লাডব্যাঙ্ক

ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে পাংশু মুখে বসেছিলেন দেবগ্রামের তরুণ পালিত। স্ত্রী তপতীদেবী শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রক্তে হিমোগ্লোবিন তলানিতে। তিন ইউনিট রক্তের প্রয়োজন।

মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজের এই হাল। — নিজস্ব চিত্র

মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজের এই হাল। — নিজস্ব চিত্র

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও শুভাশিস সৈয়দ
কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২১
Share: Save:

ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে পাংশু মুখে বসেছিলেন দেবগ্রামের তরুণ পালিত। স্ত্রী তপতীদেবী শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রক্তে হিমোগ্লোবিন তলানিতে। তিন ইউনিট রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু ব্লাড ব্যাঙ্কে এসে তিনি জানতে পারেন, রক্ত নেই! শেষতক পরিবারের সদস্যেরা রক্ত দিলে সমস্যা মেটে।

কিডনির সমস্যা নিয়ে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নওদা’র সাহিদা বিবি। তাঁরও রক্তে হিমোগ্লোবিন কম। অবিলম্বে রক্ত জোগাড় করার কথা বলেছেন চিকিৎসক। দু’দিন ধরে জেলা ব্লাড ব্যাঙ্কে চরকির মতো ঘুরছেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা। কিন্তু ‘বি’ পজিটিভ রক্ত এখন মেলেনি!

এক গরমে রক্ষা নেই, দোসর ছিল ভোট। আর এই দুইয়ের নিট ফল—ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তাল্পতা! মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের জেলা ব্লাড ব্যাঙ্কে এই মুহূর্তে কোনও গ্রুপের রক্ত নেই। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে সঙ্গে করে ‘ডোনার’ নিয়ে এসে রক্তের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে রোগীর বাড়ির লোকজনকে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ফি বছর গরমের সময় রক্তের একটা সঙ্কট তৈরি হয়। এ বছর ভোট থাকায় সেই সমস্যা আরও বেড়েছে।

রাজ্যে ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার কারণে রাজনৈতিক সংগঠনগুলি রক্তদান শিবির আয়োজন করেনি। মুর্শিদাবাদ জেলা ব্লাড ব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক প্রভাসচন্দ্র মৃধা জানান, গত ১৭ মার্চ রক্তদান শিবিরের পরে বেসরকারি উদ্যোগে আর কোনও শিবির হয়নি। ১৮ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে একটি রক্তদান শিবির হয়। সেই শিবিরে হাসপাতালের সুপার থেকে চিকিৎসক এবং কর্মীরা সকলে মিলে রক্তদান করেন। দিনকয়েক আগে রক্তের সঙ্কটের কারণে একই ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তবে বছর কয়েক আগেও রক্তের সঙ্কট এতটা হত না। সিপিএমের যুব সংগঠন, ডিওয়াইএফআই নিয়ম করে প্রতি মাসে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করত। তা থেকেই পুষ্ট হত জেলা ব্লাড ব্যাঙ্ক। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে সিপিএমের যুব সংগঠনের সেই সক্রিয়তাও তেমন ভাবে আর দেখা যায় না। সারা বছরের ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে যে রক্তদান শিবিরের আয়োজন হত এখন তা-ও প্রায় বন্ধ। ফলে ভুগতে হচ্ছে রোগী ও রোগীর বাড়ির আত্মীয়দের।

ডিওয়াইএফের রাজ্য সম্পাদক জামির মোল্লা জানান, তাঁদের রক্তদান শিবির আগের থেকে কিছুটা হলেও কমেছে ঠিকই। কিন্তু তার জন্য দায়ী রাজ্য সরকারের উদাসীনতা। বামফ্রন্ট আমলে ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সারা বছরের রক্তদান শিবিরের তারিখ দিয়ে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হত। এখন রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতে হলে প্রতি মাসে মাসে তা জানাতে হচ্ছে। কখনও দিন ঘোষণা করেও রক্তদান শিবির বাতিল করতে হচ্ছে। ফলে উৎসাহ হারিয়ে কমছে রক্তদাতার সংখ্যা।

জামিরের অভিযোগ, ‘‘রক্তদান শিবির পরিচালনার জন্য চিকিৎসক পাওয়া যায় না। টেকনিশিয়ান থাকে না। এমনকী গাড়ি পর্যন্ত ভাড়া করে দিতে হয়। তাছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক রক্তের ব্যাগ ও কিটও থাকে না। এই অবস্থায় সুষ্ঠু ভাবে রক্তদান শিবির করা সম্ভব নাকি!’’ গত জানুয়ারিতে রাজনৈতিক সংগঠনগুলি মোট ১০টি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। তার মধ্যে সিপিএমের ছাত্র ও যুব সংগঠন মিলিয়ে পাঁচটি শিবির করে। বাকি পাঁচটি শিবিরের মধ্যে চারটি করেছে শাসক দল এবং একটি কংগ্রেস। ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি উদ্যোগে ১০টি রক্তদান শিবির হয়েছে। মার্চে হয়েছে মাত্র সাতটি রক্তদান শিবির এবং এপ্রিলে একটি রক্তদান শিবির হয়েছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্যোগে।

মুর্শিদাবাদ জেলা ব্লাড ব্যাঙ্কে প্রতি দিন গড়ে ৫০ বোতল রক্তের চাহিদা থাকে। কিন্তু রক্তের এই সঙ্কটের কারণে রোগীর বাড়ির লোকজনকে এখন ‘ডোনার’ নিয়ে আসতে বলা হচ্ছে। প্রভাসচন্দ্র মৃধা বলেন, ‘‘ভোটপর্ব না মেটা পর্যন্ত এই অবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না।’’ ছবিটা বিশেষ আলাদা নয় পড়শি জেলা, নদিয়াতেও।

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ ইউনিট রক্তের দরকার পড়ে। রবিবার বাদে প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীকে রক্ত দিতে হয়। প্রসূতিদের জন্য সব গ্রুপের দু’ইউনিট করে রক্ত মজুত রাখতে হয়। এ ভাবে সবদিক সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ব্লাডব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। শনিবার মাত্র ২৫ ইউনিট রক্ত মজুদ ছিল। ফলে এখানেও দাতা এনে রক্ত নিতে হয়েছে রোগীর আত্মীয়দের।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারি হাসপাতালগুলিতে রক্তদান শিবির করার ব্যপারে উদ্যোগী হয়েছেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায়। তাপসবাবু বলেন, “প্রতি বছর গরমকালে রক্তের সঙ্কট দেখা দেয়। এ বারে ভোট ছিল। রক্তদান শিবির কম হয়েছে। ফলে সমস্যা তো রয়েইছে।’’

আশার কথা শোনাচ্ছেন শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের ইনচার্জ সোমনাথ সরকার। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার একটি রক্তদান শিবির থেকে ৪০ ইউনিট রক্ত পাওয়া গিয়েছে। আজ, সোমবার থেকে টানা পাঁচ দিন রক্তদান শিবির রয়েছে। ফলে ঘাটতি কিছুটা হলেও কমবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

blood bank blood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE