Advertisement
০৫ মে ২০২৪

নিশিদিন নোটহীন

নেই আর নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা এই একটাই শব্দ ঘুরছে মুখে মুখে। ব্যাঙ্কে গিয়ে একলপ্তে ২৪ হাজার? নাহ্, এমন আশা করাই অর্থহীন। এটিএমে টাকা নেই। পকেটে নগদ বাড়ন্ত। মাসের শেষ সপ্তাহে সেই চরম হয়রানের সাক্ষী রইল আনন্দবাজার।নেই আর নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা এই একটাই শব্দ ঘুরছে মুখে মুখে। ব্যাঙ্কে গিয়ে একলপ্তে ২৪ হাজার? নাহ্, এমন আশা করাই অর্থহীন। এটিএমে টাকা নেই। পকেটে নগদ বাড়ন্ত। মাসের শেষ সপ্তাহে সেই চরম হয়রানের সাক্ষী রইল আনন্দবাজার।

এ ভোগান্তির শেষ কবে? —গৌতম প্রামাণিক

এ ভোগান্তির শেষ কবে? —গৌতম প্রামাণিক

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:০৪
Share: Save:

মাঝ অগ্রহায়ণেও দরদর করে ঘামছে লোকটা। মাথার উপরে কোনও আচ্ছাদন নেই। নেই বসার জায়গা। কতক্ষণ আর এ ভাবে রোদ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়! করিমপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মূল গেটের সামনে লাইনটা শুরু হয়েছিল সাত সকালে। বেলা বাড়ার সঙ্গে লাইনের লেজ চলে গিয়েছে রাস্তা পর্যন্ত।

পাক্কা ঘণ্টা চারেক অপেক্ষার পরে, বিকেল তিনটে নাগাদ করিমপুরের সেই প্রৌঢ়, শঙ্কর মণ্ডল কাউন্টারের সামনে গিয়ে শুনলেন, ‘‘টাকা নেই। কাল আসুন।’’

বিঘে চারেক জমি রয়েছে শঙ্করের। পাট বিক্রি করে যা হাতে পেয়েছিলেন তা সবই ছিল পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট। দিন কয়েক আগে সে টাকাও তিনি ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছেন।

গম ও মুসুর চাষের জন্য এখন তাঁর হাজার পাঁচেক টাকা দরকার। এ দিকে কাজ কামাই করে সারাটা দিন ব্যাঙ্কে অপেক্ষার পরে তাঁকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।

শঙ্কর বলছেন, ‘‘কী বিপদে পড়লাম বলুন তো! খেতের কাজ শিকেয় তুলে এ ভাবে রোজ রোজ ব্যাঙ্কে এসে ঘুরে যেতে হলে তো খুব মুশকিল।’’

কখনও লিঙ্ক নেই, কখনও টাকা। ব্যাঙ্কে চব্বিশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাঙ্কে গিয়ে মালুম হচ্ছে সে কথা নেহাত কথার কথা। উইথড্রল ফর্ম পূরণের আগেই ব্যাঙ্কের কর্মীরা সাবধান করছেন, ‘‘আরে, কত লিখছেন? চব্বিশ-টব্বিশ নয়, পাঁচ লিখুন। তার বেশি দেওয়া যাবে না।’’

অগত্যা কোথাও পাঁচ, বরাত ভাল থাকলে দশ। আর এটিএম? টাকা না পেয়ে অনেকেই এখন সেই যন্ত্রের নাম দিয়েছেন—অল টাইম মৌন। আর ভাগ্য ভাল থাকলে মোটে দু’হাজার।

গায়ে সাদা থান। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। ডোমকলের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে অসহায় ভাবে বসেছিলেন সুবোধ হালদার। তাঁর কাকিমা মারা গিয়েছেন। আজ, বুধবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। কাশিপুর থেকে ১৪ কিলোমিটার পথ উজিয়ে ডোমকলে এসে সুবোধ বলছেন, ‘‘বাড়িতে যা অচল নোট যা ছিল তা আগেই ব্যাঙ্কে জমা দিয়েছি। শ্রাদ্ধে বহু টাকা খরচ হবে। এ দিকে টানা দু’দিন ধরে ব্যাঙ্কে এসে খালি হাতেই বাড়ি ফিরছি। অ্যাকাউন্টে টাকা রয়েছে। কিন্তু তা পাচ্ছি না। কী ভাবে যে কী করব, সেটাই বুঝতে পারছি না।’’

বুঝতে পারছেন না সুভাষনগরের রঞ্জন অধিকারীও। স্ত্রী পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। ওষুধ আর ফিজিওথেরাপি বাবদ মাসে ছ’হাজার টাকা খরচ হয়। এ মাসটা তিনি ধারে চালিয়েছেন। এ বার সেই ধার শোধ না করলে ওষুধ ও ফিজিওথেরাপি দুই-ই বন্ধ হয়ে যাবে।

এ দিন গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দোগাছি শাখা থেকে বেরনোর সময় তিনি বলছেন, ‘‘দশ হাজার টাকা তুলব বলে এসেছিলাম। কিন্তু হাতে পেলাম মাত্র দু’হাজার টাকা। এই টাকায় কী হবে?’’

ডোমকলের গোবিন্দপুর গ্রামের ফরিদা বিবির মেয়ে অসুস্থ। মঙ্গলবার চিকিৎসার জন্য টাকা তুলতে এসে তাঁকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। ফরিদা বলছেন, ‘‘ব্যাঙ্কে টাকা আছে। অথচ সে টাকা তুলতে পারছি না। এ দিকে মেয়েটা বাড়িতে শুয়ে কষ্ট পাচ্ছে। এ কী দিন এল বলুন তো?’’ জলঙ্গির একটি এটিএমে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩ টে পর্যন্ত চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেও টাকা মেলেনি।

টাকা না পেয়ে এ দিন বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কের লালগোলার ময়া পণ্ডিতপুর শাখার আধিকারিককে মঙ্গলবার গ্রাহকেরা ঘেরাও করে রাখেন বলে অভিযোগ। পরে লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি সামলায়। এর আগেও বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কের নবগ্রাম ব্লকের পাশলা শাখার গেটে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা।

মুর্শিদাবাদের রাষ্ট্রায়ত্ত লিড ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমিত সিংহ জানান, মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্ক এতদিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের টাকা পেত অ্যাক্সিস, স্টেট ব্যাঙ্ক ও ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের কাছ থেকে। কিন্তু টাকার জোগান কম থাকায় ওই ব্যাঙ্কগুলির পক্ষেও টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্ক।’’

ব্যাঙ্ক ও এটিএমে টাকার সমস্যা প্রসঙ্গে অমিতবাবু বলছেন, ‘‘চাহিদার থেকে সর্বত্রই টাকার জোগান কম। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার নেই।’’

নদিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত লিড ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুগত লাহিড়ি বলছেন, ‘‘জেলার ব্যাঙ্কগুলোতে যে টাকা আসছে তা প্রযোজনের তুলনায় কম। সেই টাকাও সমস্ত গ্রাহককে ভাগ করে দিতে হচ্ছে। সেই কারণেই এই সমস্যা।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘তবে পরিস্থিতি খুব শিগ্‌গির স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’

সেই ‘অচ্ছে দিন’-এর অপেক্ষায় দিন গুনছে দুই জেলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Bank Problem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE