Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

এক ফোনেই মিলছে অ্যাসিড

সাকুল্যে এক কাপ অ্যাসিড! তা দিয়েই অনায়াসে পুড়িয়ে দেওয়া যায় একটা মুখ। ছারখার করে দেওয়া যায় আস্ত জীবন। অথচ খোলা বাজারে চাইলেই মিলে যাচ্ছে সেই মারণ-তরল। নুন, তেল, আনাজের মতোই!

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৬
Share: Save:

সাকুল্যে এক কাপ অ্যাসিড!

তা দিয়েই অনায়াসে পুড়িয়ে দেওয়া যায় একটা মুখ। ছারখার করে দেওয়া যায় আস্ত জীবন।

অথচ খোলা বাজারে চাইলেই মিলে যাচ্ছে সেই মারণ-তরল। নুন, তেল, আনাজের মতোই!

কিন্তু এ ভাবে কি অ্যাসিড বিক্রি করা যায়?

উত্তর হচ্ছে, না। অ্যাসিড হামলার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে একটি মামলার শুনানির সময় শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, যাঁদের অ্যাসিড বা ওই ধরনের বিপজ্জনক দ্রব্য বিক্রির অনুমোদন রয়েছে, তাঁদের কাছে একটি রেজিস্টার থাকবে। সেখানে ক্রেতার ঠিকানা লিখে রাখতে হবে। সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ অ্যাসিড কিনতে পারবেন না।

আর ১৮-র কম বয়সি কাউকে অ্যাসিড বিক্রি করাও যাবে না। তাঁর কাছে কত অ্যাসিড রয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখতে হবে বিক্রেতাকে। কেউ যদি অ্যাসিডের পরিমাণ না জানান, তা বাজেয়াপ্ত করে বিক্রেতার ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট এটাও জানায় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার, হাসপাতাল এবং সরকারি দফতরগুলি নিজস্ব প্রয়োজনে বেশি পরিমাণে অ্যাসিড রাখতে পারে। তবে তাদেরও কিছু নির্দেশ মানতে হবে। সংস্থার এক জনকে গোটা বিষয়টির দায়িত্বে রাখা হবে। যাঁরা অ্যাসিড ব্যবহার করেন, তাঁদের উপরে বাধ্যতামূলক নজরদারি চালানো হবে। রেজিস্টারে তথ্য রাখা হবে এবং সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে তা জানাতে হবে।

যা শুনে আকাশ থেকে পড়ছেন নদিয়ার এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। বলছেন, ‘‘ও বাবা, এত সব নিয়ম আছে নাকি! বছর কয়েক আগে খবরের কাগজে একবার অ্যাসিড বিক্রি নিয়ে কী সব নিয়ম-টিয়মের কথা পড়েছিলাম বটে। কিন্তু এত কিছু তো জানি না।’’

ছবিটা একই রকম পড়শি জেলা, মুর্শিদাবাদেও। ব্যাটারির দোকান কিংবা সোনার দোকানে চাইলেই মিলে যায় অ্যাসিড। মুর্শিদাবাদের এক অ্যাসিড বিক্রেতা বলছেন, ‘‘চেনাজানা লোক ছাড়া আমরা তো অ্যাসিড বিক্রি করি না। ফলে অসুবিধা কোথায়?’’

নাম, ঠিকানা লিখে রাখার পাশাপাশি ক্রেতাদের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখেন না? বিরক্ত হয়ে ওই বিক্রেতার জবাব, ‘‘এ সব করতে হলে তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য এত খাটনি পোষাবে না দাদা।’’

রাগ করে স্ত্রী চলে গিয়েছিলেন বাবার বাড়ি। ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে না পেরে বাড়িতে বসে ছটফট করছিল করিমপুরের এক যুবক। তারপর ছেলের পরীক্ষার নাম করে ডেকে এনে ভরা বাজারে স্ত্রীর মুখে অ্যাসিড ছুড়েছিল সে। নিজে স্বর্ণশিল্পী হওয়ার সুবাদে অ্যাসিড জোগাড় করতে ওই যুবককে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। বেগ পেতে হয় না আম আদমিকেও।

সে কথা কবুল করছেন করিমপুর স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বাসুদেব সরকারও। তিনি জানাচ্ছেন, সোনার দোকানে নাইট্রিক ও সালফিউরিক অ্যাসিড রাখতেই হয়। সংগঠনের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের অ্যাসিড বিক্রির ব্যাপারে তাঁরা সতর্ক ও সচেতন করেছেন। তাঁর সংযোজন, ‘‘তবে সত্যি কথা বলতে, এখনও পর্যন্ত একটা মস্ত বড় ফাঁক থেকেই গিয়েছে। প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ না করলে বেআইনি ভাবে অ্যাসিড বিক্রিতে লাগাম টানা একা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’’

শুধু কৃষ্ণনগরেই আছে প্রায় চারশো সোনার দোকান। অথচ বেশির ভাগ বিক্রেতাদেরই অ্যাসিড বিক্রি ও মজুত রাখার লাইসেন্স নেই। রাখা হয় না রেজিস্টারও। সিংহ ভাগ অ্যাসিড সরবরাহকারীদের অবস্থাও তথৈবচ। শুধুমাত্র পুরসভা কিংবা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স সম্বল করেই চলছে অ্যাসিড কারবার। মাঝেমধ্যে ক্রেতাকে দোকানে পর্যন্ত আসতে হয় না, ফোন করলে বাড়িতে পর্যন্ত পৌঁছে যায় অ্যাসিড!

কৃষ্ণনগর শহরে স্বর্ণব্যবসায়ীদের অ্যাসিড সরবরাহ করেন এক যুবক। তিনি বলছেন, ‘‘সকলেই আমার চেনা লোক। অসুবিধা তো কিছু হয় না।’’ তিনি জানাচ্ছেন, তবে কখনও কখনও সংগঠনের পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হয়। কিন্তু সংগঠনের পরিচয়পত্র তো আর অ্যাসিড বিক্রির লাইসেন্স হতে পারে না।

অখিল ভারতী স্বর্ণকার সঙ্ঘের রাজ্য কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অক্ষয় ভট্টাচার্য বলেন, “এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথও তো খোলা নেই। অ্যাসিড বিক্রি কিংবা মজুত রাখার লাইসেন্স নেই কারও। তাঁরা জানেনও না যে, সরকারি কী নিয়ম-কানুন আছে। কারণ, সরকার বা প্রশাসনের তরফে কোনও দিন আমাদের এই বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। যেটুকু জেনেছি তা সংবাদমাধ্যম থেকেই।”

স্বর্ণব্যবসায়ীদের না হয় একটা সংগঠন আছে। কিন্তু ব্যাটারির দোকান? সেখানে অবস্থা আরও করুণ। কারণ, তাঁদের কোন সংগঠনও নেই। ফলে ব্যাটারির ব্যবসায়ীদের একাংশ অবাধে ব্যবসা করছেন বলেই অভিযোগ। হাঁসখালিতে অ্যাসিড হামলায় নিহত ছাত্রীর ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ এক ব্যাটারির দোকানের মালিককে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের দাবি, অ্যাসিড কেনা হয়েছিল ওই ব্যাটারির দোকান থেকেই।

কৃষ্ণনগরের এক ব্যাটারি ব্যবসায়ী দেবরাজ সাহা বলছেন, ‘‘বেআইনি ভাবে কেউ ব্যবসা করতে চায় নাকি? কিন্তু নিয়মটাই যদি আমাদের না জানানো হয় তাহলে কী করে বুঝব নিয়মটা কোথায় ভাঙা হচ্ছে।’’

এ দিকে খোলাবাজারে কার্বোলিক অ্যাসিড অবাধে বিক্রি হচ্ছে। মুদি থেকে ওষুধের দোকানে চাইলেই মিলে যায় সেই অ্যাসিড। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ত্বক বিশেষজ্ঞ ধ্যানতোষ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সালফিউরিক ও নাইট্রিকের মতোই বিপজ্জনক কার্বোলিক অ্যাসিড। ত্বকের উপরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।’’

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রসায়নের পরীক্ষাগারেও নানা ধরনের অ্যাসিড রাখা হয়। শান্তিপুর কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান সঞ্জয় ধাড়া জানান, কলেজে অ্যাসিড অত্যন্ত কড়া নজরদারিতে ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে অ্যাসিড বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই দাবি সঞ্জয়বাবুর।

এ তো গেল অ্যাসিড কারবারিদের কথা। কিন্তু এই অ্যাসিড বিক্রির উপরে যারা আইন তৈরি করেছে, লাইসেন্স দেওয়ার পাশাপাশি যাদের নজরদারি করার কথা, নেওয়ার কথা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, সেই প্রশাসন কী করছে?

আরও কত অ্যাসিড হামলার পরে ঘুম ভাঙবে তাদের?

(তথ্য সহায়তা—সুস্মিত হালদার, শুভাশিস সৈয়দ, সুজাউদ্দিন, সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়, কল্লোল প্রামাণিক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE