Advertisement
০৬ মে ২০২৪

কুপন কই, কয়লার ট্রাক দেখলেই প্রশ্ন পুলিশের

সকাল পৌনে সাতটা। বর্ধমানের নাদনঘাট। হালকা কুয়াশায় তখনও ঢেকে কালনা-কাটোয়া রাজ্য সড়ক। রাস্তার ধারে চায়ের গুমটিতে জনা-দশেক লোকের জটলায় গল্পের মধ্যেই হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। চাদর-গায়ে, টুপি-মাথায় রোগা এক লোক ফোন তুলে ধমক দিলেন, “গাড়ি এল না কেন এখনও?” খানিক পরেই ঢুকল ছ’চাকার একটা ট্রাক।

এই কুপন দেখিয়েই ঢুকতে পারে কয়লার ট্রাক।—নিজস্ব চিত্র।

এই কুপন দেখিয়েই ঢুকতে পারে কয়লার ট্রাক।—নিজস্ব চিত্র।

মনিরুল শেখ
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৯
Share: Save:

সকাল পৌনে সাতটা। বর্ধমানের নাদনঘাট। হালকা কুয়াশায় তখনও ঢেকে কালনা-কাটোয়া রাজ্য সড়ক। রাস্তার ধারে চায়ের গুমটিতে জনা-দশেক লোকের জটলায় গল্পের মধ্যেই হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। চাদর-গায়ে, টুপি-মাথায় রোগা এক লোক ফোন তুলে ধমক দিলেন, “গাড়ি এল না কেন এখনও?” খানিক পরেই ঢুকল ছ’চাকার একটা ট্রাক। ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কয়লা। রোগা লোকটি ট্রাক চালকের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কী যেন হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখা শেষ হলে হাত নাড়লেন। ট্রাক চলে গেল। মিনিট দশেক পর ফের আরেকটি কয়লার ট্রাক। ফের পরীক্ষা।

কী দেখছিলেন দাদা? সিগারেটে টান দিয়ে ‘দাদা’ বললেন, “কুপন।” কেন? প্রশ্ন করতেই চোখ সরু করে তাকালেন। “কোথায় থাকেন? জানেন না আমাদের কুপন ছাড়া কোনও কয়লার গাড়ি এখানে ঢুকতে পারে না?”

কুপনের একটা নমুনা অবশ্য পকেটেই ছিল। ‘নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট কোল ট্রান্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফে ছাপানো ওই কুপনে লেখা ‘মেম্বার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড ডোনেশন কুপন।’ অর্থাৎ, সদস্যদের কল্যাণ তহবিলে দান। তাতে সংগঠনের সম্পাদক এবং ‘কালেক্টর’-এর সইও রয়েছে। রয়েছে রেজিস্ট্রেশন নম্বর। এমনকী তারিখও। কুপনে ছাপানো মূল্য লেখা ১০ টাকা। অর্থাৎ দানের মূল্য ১০ টাকা মাত্র! যদিও এটা শুনেই হেসে উঠলেন ট্রাক চালকেরা! এবং সেই কয়লা যাঁরা নিচ্ছেন তাঁরাও! এঁদের অভিযোগ, ছ’চাকার গাড়ি হলে ‘ট্রিপ’ পিছু দু’হাজার টাকা দিয়ে কুপন কিনতে হয় ওই ‘অ্যাসোসিয়েশন’-এর থেকে। দশ-চাকার গাড়ি হলে সেটাই হয়ে যায় চার হাজার টাকা। এক ট্রাক মালিক সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন একটি গাড়ি দিনে তিন বার কয়লা নিয়ে ঢুকলে তিন বারই তাকে কুপন কিনতে হবে! কুপনের নীচে লেখা, কেবল সদস্যদের থেকেই ‘দান’ নেওয়া হবে। জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, ওই ‘অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য হতে গেলে বছরে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে!

এ ভাবেই চলছে নদিয়ার বৃহত্তম কয়লা সিন্ডিকেট। অভিযোগ, এ ভাবে কুপন ‘বেচে’ বছরে অন্তত ১১ কোটি টাকা আয় হয় সিন্ডিকেট-কর্তাদের! এবং নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালাতে সেই টাকা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হয়।

“ওই কুপন ছাড়া জেলায় কোনও কয়লার গাড়ি ঢুকতে পারে না,” বললেন নদিয়ার এক ইটভাটার মালিক। নদিয়ায় প্রায় ছ’শোটি ইটভাটা রয়েছে। তার অন্তত অর্ধেকই অবৈধ, মেনে নিচ্ছে জেলা প্রশাসন। প্রতি বছর এক-একটি ভাটায় প্রায় ৩৫০ টন কয়লা লাগে। অবৈধ ভাটার মালিকদের সিন্ডিকেট নিয়ে আপত্তি করার জো নেই, কারণ তাঁরা বৈধ উপায়ে কয়লা আনতে পারবেন না। আপত্তি তুলছেন বৈধ ভাটার মালিকরা। বৈধ ভাটার মালিকদের অভিযোগ, তাঁদের কাছে কয়লা আনার কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও শুধু মাত্র এই কুপনের দাপটে তাঁদের বছরে গড়ে দু’লক্ষ টাকা ‘ঘুষ’ দিতে হচ্ছে সিন্ডিকেটকে!

সংকট এতই তীব্র হয়েছে যে, সম্প্রতি ইটভাটা মালিকরা নদিয়ার পুলিশ সুপারের দ্বারস্থ হয়েছেন। ‘নদিয়া ব্রিকফিল্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক গত ২০ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে পুলিশ সুপারকে লিখছেন, “বেশ কিছু দিন হইল এই (কয়লা) আনয়নের ক্ষেত্রে পুলিশ বিভিন্ন প্রকারের বাধার সৃষ্টি করিতেছে এবং মৌখিক ভাবে জানাইতেছে যে প্যাড/কুপন ব্যতীত কোনও কয়লা যাবে না। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়েছে যে, কোনও গাড়ি প্যাড ব্যতীত কোনও কয়লা লোড করিতে রাজি হচ্ছে না।” নদিয়ার পুলিশ সুপার, ট্রাফিকের ওসি, কোতয়ালি থানা এবং নবদ্বীপ থানার আইসি-কে আইনি নোটিসও পাঠিয়েছেন ১১ জন ইটভাটা মালিক। সূত্রের খবর, তার পরেই পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষের নির্দেশে ইটভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন জেলা পুলিশের ডিএসপি (সদর) অভিষেক মজুমদার।

কিন্তু পরিস্থিতি কি বদলেছে?

পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে লাভ হল কি না, তা বুঝতে ওই ১১ জন মালিকের দু’জন নিজেরাই একটি কয়লার ট্রাক নিয়ে রানীগঞ্জ থেকে নদিয়া আসেন। তাঁদেরই একজন, কৃষ্ণেন্দু রায়ের অভিযোগ, ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা নাগাদ তাঁদের কয়লার ট্রাক নবদ্বীপ থানা এলাকায় ঢুকতেই পুলিশ আটকায়। “এক এএসআই আমার কাছে কুপন দেখতে চান। আমি বৈধ কাগজপত্র দেখাতে গেলাম। তিনি সটান বললেন, ‘কোনও কাগজে কাজ হবে না! পুলিশ সুপারের নির্দেশ, কুপন ছাড়া কোনও কয়লার গাড়ি জেলায় ঢুকবে না।’ আমাদের ট্রাক নিয়ে গেল থানায়।”

রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ট্রাক আটকে রাখে নবদ্বীপ থানা। অভিযোগ, নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র তখন থানাতেই ছিলেন। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, “আমি তপনবাবুকে আমাদের আইনি নোটিস দেখাই। বলি, আদালতে গিয়ে ব্যবস্থা নেব। তারও এক ঘণ্টা পরে গাড়ি ছাড়ে।”

পুলিশ যে তাঁদের মুঠোয়, তা বোঝালেন কুপন-চক্রের পাণ্ডারাও। সিন্ডিকেটের অফিস কৃষ্ণনগরের গোয়ারি বাজারে। বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, এক-কামরা অফিসের বাইরে খোলা জায়গায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে জনা সাতেক মাঝবয়সী লোক। কয়লার ব্যবসায় নামতে চাই, বলতেই নির্দেশ এল, “ব্যবসা করতে গেলে সিন্ডিকেটের সদস্য হতে হবে। ফি বছরে ২৫ হাজার টাকা।” এত টাকা? কড়া গলায় জবাব এল, “এটা মাছের বাজার নয়। পাঁচ টাকাও কম হবে না।” কোন থানার অধীনে ভাটা রয়েছে, সিন্ডিকেটকে জানাতে হবে। সিন্ডিকেটের মাইনে-করা লোকের কাছে ওই এলাকার কুপন-প্রাপ্ত ট্রাকের তালিকা থাকে। কুপন কেনার পরেও পুলিশ হরয়ান করবে না তো? জবাব এল, “পুলিশ ধরলেই ফোন করবেন। সব ম্যানেজ করে দেব!” আর এক জনের আশ্বাস, “আরে আমাদের কুপন থাকলে পুলিশ চুপ!”

কী বলছে পুলিশ? তাঁর নির্দেশে পুলিশের কুপন পরীক্ষার অভিযোগ সটান অস্বীকার করলেন এসপি অর্ণব ঘোষ। তিনি বলেন, “ওই পুলিশকর্মী মনগড়া কথা বলেছেন। আমি কুপন দেখার নির্দেশ দিইনি। প্রয়োজনে ওদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করব।” কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি ইটভাটা মালিকদের অভিযোগপত্র এবং তারও এক সপ্তাহ আগে আইনি নোটিস মিলেছে। তার পরেও কেন তদন্ত এগোল না? অর্ণববাবুর জবাব, “বিষয়টি দেখছি।”

নবদ্বীপ থানার আইসি তপনবাবুর দাবি, “আমার থানার কোনও কর্মী কুপন দেখেন না।” তা হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কুপন না পেয়ে পুলিশ ট্রাক আটকাল কেন? আইসি-র উত্তর, “ওটা ওই পুলিশকর্মীর দায়! আমি কিছু বলব না।”

সিন্ডিকেটের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কের ইঙ্গিত দিলেন ইটভাটা মালিকদের সংগঠনের সভাপতি সুনীলকুমার পাল। নিজে জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য, তবু কেন কুপন-চক্রের প্রতিকার করতে পারছেন না? সুনীলবাবুর স্পষ্ট জবাব, “সিন্ডিকেটের লোকজন আমাদেরই বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছে!” ইটভাটা মালিকদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে সিন্ডিকেটের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে, এক সময়ে কৃষ্ণনগর-সদর ডিভিশনের ট্রাফিক পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কাছ থেকে কুপন সংগ্রহ করেছেন তাঁরা! কৃষ্ণনগর সদর ডিভিশনের ট্রাফিক ওসি ব্রজ দত্ত অবশ্য বলেন, “আমি সিন্ডিকেটের লোকজনকে চিনি। কিন্তু ওদের কুপন বিলি নিয়ে কিছু জানি না।”

পুলিশকর্তারা যা-ই বলুন, থানা এবং ট্রাফিক পুলিশ যে কুপন ব্যবস্থা নিয়ে ওয়াকিবহাল, তা দেখা গেল সরেজমিনে। মার্চের গোড়ায় বর্ধমানের নাদনঘাট থেকে কয়লার ট্রাক ধাওয়া করে আসা গেল নবদ্বীপে। গৌরাঙ্গ সেতুতে ওঠার মুখেই পুলিশের ভ্যান। দেখা গেল, অবিকল নাদনঘাটের সিন্ডিকেট সদস্যের মতোই ট্রাক থামিয়ে কুপন পরীক্ষা করছে পুলিশ! কুপন দেখে তবেই গাড়ি ছাড়ছে। চব্বিশ ঘণ্টায় প্রায় ১৫০ ট্রাক নদিয়ায় ঢোকে গৌরাঙ্গ সেতু পেরিয়ে।

কী বলছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা? সম্পাদক সুবীর চক্রবর্তী ওরফে বুবাই বলেন, “সদস্যদের কল্যাণের জন্য কুপন বিক্রি করছি।” কিন্তু সেই কুপন পুলিশ দেখতে চায় কেন? “সেটা আমার জানা নেই। পুলিশ পুলিশের কাজ করছে।” কিন্তু পুলিশ যে কুপন না পেলে ট্রাক আটকাচ্ছে এবং তা নিয়ে অভিযোগও হয়েছে? নাদনঘাটে সিন্ডিকেট কর্মীর কুপন পরীক্ষার প্রমাণও যে মিলেছে, সে বিষয়েই বা কী বলবেন? ক্ষুব্ধ সুবীরবাবুর জবাব, “আপনি প্রমাণ নিয়ে থাকুন! আমি বুঝে নেব!”

কয়লা পরিবহণ ব্যবসায়ীদের একাংশও সিন্ডিকেটের কাজে ক্ষুব্ধ। তাঁদের বক্তব্য, সিন্ডিকেটের সদস্য ১০-১২ জন এ ভাবে টাকা তুলছেন। বাকিরা ভুগছেন। “আমরা বৈধ ভাবে কয়লা কিনে ইটভাটায় বেচি। অ্যাসোসিয়েশন করার প্রয়োজন কী?” বললেন কৃষ্ণনগর মহকুমা এলাকার এক ব্যবসায়ী। তাঁর ক্ষোভ, এক দিকে সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হয়, দাদাগিরি সহ্য করতে হয়। অন্য দিকে ওই টাকা উসুল করতে বাড়তি দাম চাইতে হয় ভাটা মালিকের কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

coal truck coupons police manirul shekh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE