এক মাস অতিক্রান্ত। রানাঘাট-কাণ্ডে মূল অভিযুক্তদের গ্রেফতার তো দূরের কথা, তাদের হদিসই করতে পারছে না সিআইডি!
রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে যে আট জনের নাম উঠেছে, সিআইডি-র তদন্তকারীরা এ পর্যন্ত তাদের দু’জনকে ধরতে পেরেছেন। যদিও ধৃতদের এক জন ঘটনার রাতে রানাঘাটে আদৌ উপস্থিত ছিল কি না, সে সম্পর্কে গোয়েন্দারা নিশ্চিত নন।
এমতাবস্থায় রাজ্য পুলিশের একাংশের পর্যবেক্ষণ, রানাঘাট-কাণ্ডে সিআইডি-তদন্তের কার্যত কোনও অগ্রগতি-ই হয়নি। ‘‘সিআই়ডি দাবি করেছিল, পঞ্জাবের লুধিয়ানায় ধরা পড়া দুষ্কৃতীদের পশ্চিমবঙ্গ-যোগ রয়েছে। পরে দেখা গেল, ওদের সঙ্গে রানাঘাট-কাণ্ডের সম্পর্কই নেই। এমনকী, রানাঘাটের মূল পাণ্ডা হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশি মিলন সরকারেরও কোন খোঁজ সিআইডি পায়নি।’’— বলছেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা। সিআইডি-কর্তারা অবশ্য এখনই ব্যর্থতার তত্ত্ব মানতে নারাজ। ওঁদের বক্তব্য: তদন্ত শেষ হয়নি। অন্য অভিযুক্তদের সন্ধান চলছে। পাসপোর্টধারী চার পলাতকের নামে ‘লুক আউট সার্কুলার’ও জারি হয়েছে।
১৩ মার্চ গভীর রাতে রানাঘাটের এক কনভেন্ট স্কুলে দুষ্কৃতীরা হানা দিয়েছিল। ডাকাতির পরে স্কুলের এক বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে তারা ধর্ষণও করে। ঘটনাটিকে ঘিরে রাজ্য তো বটেই, সারা দেশ, এমনকী আন্তর্জাতিক মহলেও শোরগোল পড়ে যায়। সিআইডি তদন্তে নামে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরে সিবিআই-তদন্তের সুপারিশ করলেও কেন্দ্রীয় ব্যুরো জানায়, তারা অপারগ।
এরই মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে মুম্বইয়ে মহম্মদ সালিম শেখ এবং হাবরায় গোপাল সরকার নামে দু’জনকে রানাঘাট-কাণ্ডে জড়িত অভিযোগে সিআইডি গ্রেফতার করে। সিআইডি’র দাবি, অপরাধের সময়ে সালিম ঘটনাস্থলে হাজির ছিল। যদিও স্কুলের সিসিটিভি-ফুটেজে তাকে দেখা যায়নি। আর গোপাল সম্পর্কে সিআইডি’র অভিযোগ: রানাঘাট-কাণ্ডে জড়িত আট দুষ্কৃতীকে সে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। পরে গোপাল ও সালিম অভিযুক্তদের শনাক্ত করেছে বলেও জানিয়েছে সিআইডি।
কিন্তু তদন্তের গতি ওখানেই থমকে গিয়েছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ‘ব্যর্থতা’র তোপের মুখে পড়েছে সিআইডি। রাজ্য পুলিশের একাংশ বলছেন, এটা নতুন কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে খাগড়াগড়-কাণ্ডের উদাহরণও দিচ্ছে তাঁরা। কী রকম?
রাজ্য পুলিশের খবর: সিআইডি-ই প্রথমে খাগড়াগড়ের তদন্ত করেছিল। পরে এনআইএ আসে। ঘটনার দু’সপ্তাহ বাদে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা ৪৫টি বিস্ফোরক উদ্ধার করে বর্ধমানের বাদশাহি রোডে, অভিযুক্ত রিয়াজুল করিমের বাড়ি থেকে। অথচ ওই বাড়িতে আগে তল্লাশি চালিয়েও সিআইডি বিস্ফোরকের নাগাল পায়নি! একই ভাবে সিআইডি’র ‘ব্যর্থতা’ প্রসঙ্গে বীরভূমের সাত্তোর-কাণ্ডের উল্লেখ করা হচ্ছে। সাত্তোরে সিআইডি-র পেশ করা চার্জশিট সম্প্রতি জেলা আদালত ফিরিয়ে দিয়েছে। বস্তুত সাত্তোর-তদন্ত নিয়ে গত এক মাস যাবৎ সিআইডি-কে আদালতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে।
এমন অবস্থা কেন?
সিআইডি-তে কাজ করে আসা কিছু পুলিশ অফিসারের ব্যাখ্যা: ২০১১-য় পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটা ইস্তক সিআইডি রাজনৈতিক ঘটনার তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধের তদন্ত চলে গিয়েছে পিছনের সারিতে। এমনকী, এক সময় ‘সোর্স মানি’ও বন্ধ হয়ে যায়। রাজ্য পুলিশের পোড় খাওয়া এক ইনস্পেক্টরের আক্ষেপ, ‘‘সোর্স নেটওয়ার্কের জন্য আগে বড় কর্তারা আমাদের উপরে নির্ভর করতেন। এখন উল্টো। কঠিন কঠিন অপরাধের কিনারা করা অনেক দক্ষ অফিসার হয় বদলি হয়ে গিয়েছেন, কিংবা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।’’
তবে নবান্ন-সূত্রের খবর: সিআইডি-র এডিজি রাজীব কুমার এখন তাঁর দফতরকে ঢেলে সাজতে চাইছেন। রানাঘাট-কাণ্ডের পলাতক দুষ্কৃতীদের পাকড়াও করতে দুই ডিএসপি’র নেতৃত্বে বিশেষ দল গড়া হয়েছে।রানাঘাটের ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় নিগৃহীতা সন্ন্যাসিনী রাজ্য দিল্লি চলে গিয়েছেন। সিআইডি-র অনুরোধে ইতিমধ্যে তিনি দিল্লির আদালতে গোপন জবানবন্দিও দিয়েছেন। ধৃত গোপাল সরকারও রানাঘাট আদালতে গোপন জবানবন্দি দিয়েছে।
গোয়েন্দাদের দাবি, এই সব জবানবন্দি তদন্তকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। ‘‘হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু অপরাধীরা জালে পড়বেই।’’— প্রত্যয়ী মন্তব্য এক সিআইডি-কর্তার। অন্য দিকে রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্য সুমন মজুমদার সোমবার বলেন, ‘‘এক মাস কেটে গেলেও পুলিশ, সিআইডি কেউই কিছু করতে পারল না! এ বার সকলের উচিত প্রতিবাদে সামিল হওয়া।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy