Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ব্যর্থতা ঢাকতেই সিবিআই, ক্ষুব্ধ খ্রিস্টান সমাজ

সিসিটিভি ফুটেজে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে অভিযুক্তদের মুখগুলো। তবু রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তের দায় সিবিআইয়ের ঘাড়ে কেন চাপিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বুঝে উঠতে পারছেন না ভেরোনিকা গঞ্জালভেস বা রিচার্ড দাসেরা। বিশেষত, সেই সিবিআই যাদের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তের তত্ত্ব’ তুলে ধরতে সদা মুখিয়ে থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ট্যাংরার সেন্ট সেবাস্টিয়ান ডে স্কুলের শিক্ষক রিচার্ড বা বৌবাজারের সাবেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা বো ব্যারাকস-এর বাসিন্দা ভেরোনিকা দু’জনেই গত সোম-সন্ধ্যায় অ্যালেন পার্কের শোক-সমাবেশে সামিল হয়েছিলেন।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

সিসিটিভি ফুটেজে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে অভিযুক্তদের মুখগুলো। তবু রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তের দায় সিবিআইয়ের ঘাড়ে কেন চাপিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বুঝে উঠতে পারছেন না ভেরোনিকা গঞ্জালভেস বা রিচার্ড দাসেরা।

বিশেষত, সেই সিবিআই যাদের বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তের তত্ত্ব’ তুলে ধরতে সদা মুখিয়ে থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

ট্যাংরার সেন্ট সেবাস্টিয়ান ডে স্কুলের শিক্ষক রিচার্ড বা বৌবাজারের সাবেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লা বো ব্যারাকস-এর বাসিন্দা ভেরোনিকা দু’জনেই গত সোম-সন্ধ্যায় অ্যালেন পার্কের শোক-সমাবেশে সামিল হয়েছিলেন। রিচার্ডের কথায়, “মনে হচ্ছে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই বোঝাটা সিবিআইয়ের দিকে ঠেলে দিল রাজ্য সরকার! এর মধ্যে আমি অন্তত ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বো ব্যারাক-চত্বরে সান্ধ্য আড্ডায় এই অভিমতের পাল্লাই কিন্তু ভারী। ভেরোনিকার পাশেই বসে ছিলেন এঞ্জেলা গোবিন্দরাজ। কথা কেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “সিবিআই তদন্ত নয়, বিষয়টাকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল বলতে পারেন।” কেন? এঞ্জেলা- ভেরোনিকাদের যুক্তি, সিবিআইয়ের উপরে তদন্তের চাপ তো নেহাত কম নয়! তাই রাজ্যের ভিতরের এই ঘটনায় ফের তাদের শরণ নিলে রাতারাতি ‘ম্যাজিক’ ঘটবে ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং পুরো প্রক্রিয়াটাই ঢের পিছিয়ে গেল।

“এত সূত্র পেয়েও হাল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কিন্তু রাজ্যের তরফে দায় এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা দেখছি,” ঝাঁঝিয়ে উঠলেন এঞ্জেলা। রবিবার সকালে কাগজে রানাঘাটের ঘটনাটি পড়ার পর থেকে রাতে ভাল ভাবে ঘুমোতে পারেননি মধ্যবয়সিনী বধূ।

ক্যালকাটা বয়েজ স্কুলের অধ্যক্ষ রাজা ম্যাকগি বা সেন্ট পলস্ স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা মন্টু রক্ষিতও সেটাই বলছেন। রাজার কথায়, “জানি না, সিবিআই দিয়ে কত দূর কী হবে! তবে এটুকু বুঝি, দেরিতে বিচার মানে বিচারের দফা রফা!”

গাংনাপুরের কনভেন্ট স্কুল-প্রাঙ্গণে তাণ্ডব ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভের মেজাজ এ ভাবেই দানা বাঁধছে এ রাজ্যের খ্রিস্টান সমাজে। শাসক দলের তরফে হঠাৎ সিবিআই তদন্তে আস্থা কেন, তা ব্যাখ্যা করে রাজ্যের প্রাক্তন মনোনীত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বিধায়ক, বর্তমানে বিজেপি নেতা ব্যারি ও’ব্রায়েন অভিযোগ করছেন, “মুখ্যমন্ত্রী ভোটের আগে নিজের প্রশাসনে আস্থা না-রেখে সিবিআইকে ডাক দিচ্ছেন। এ হল বিপদে পড়ে প্যানিক বোতামে চাপ দেওয়া!”

রানাঘাটের ঘটনা নিয়ে তীব্র ক্ষোভের এই আবহে শাসক দলের অন্দরে খ্রিস্টান সমাজের প্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন নিজে গাংনাপুরে গেলেন না কেন? কারও কারও প্রশ্ন, সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে ঘটনাটি নিয়ে বিতর্কই বা এড়িয়ে গেলেন কেন? বো ব্যারাকের রেজিনাল্ড দাস, মেলভিন সেভিল থেকে শুরু করে শিক্ষিকা মন্টুদেবী অনেকেই হতাশ বিষয়টি নিয়ে। এঞ্জেলার কটাক্ষ, “গাংনাপুরের ঘটনার পরে রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতার দিক নিয়ে উনি কিছু বলবেন না। নেত্রী বা রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলার পরিস্থিতি হলেই ওঁর মুখে কুলুপ।” ডেরেক নিজে অবশ্য এমন সমালোচনায় খুবই মর্মাহত। তাঁর দাবি, “আমিই তো প্রথম বিষয়টা রাজ্যসভায় তুলেছি। দেশের ক্যাথলিক সমজের শীর্ষস্তরের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা সকলে জানেন আমি বিষয়টা নিয়ে কতটা আলোড়িত, কলকাতার আর্চবিশপও সেটা জানেন!” দিল্লিতে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিনিধিদের জড়ো করা থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন বন্ধে দেশের খ্রিস্টান সাংসদদের একজোট করার প্রয়াসেও তিনিই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন বলে ডেরেক দাবি করেছেন।

রানাঘাটের ছায়ায় কয়েকটি পুরনো ক্ষতও খুঁচিয়ে উঠছে। বো ব্যারাক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষিতা সদ্যপ্রয়াত সুজেট জর্ডনের জন্যই বা শাসক দলের কোন নেতা পথে নেমেছিলেন? সুজেটের শেষকৃত্যেও শাসক দলের কাউকে দেখা যায়নি। রাজার কথায়, “সুজেটের ঘটনাই বুঝিয়ে দিয়েছে, এ রাজ্যে নির্যাতিতা মেয়েরা কতটা অসহায়।” আর প্রাক্তন বিধায়ক ব্যারির মতে, পার্ক স্ট্রিট থেকে রানাঘাট, মমতার দায় এড়ানোর প্রবণতা একই রকম রয়েছে। ব্যারির কথায়, “পার্ক স্ট্রিটকে সাজানো ঘটনা বলে দেগে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বার গাংনাপুরের বর্বরতার মধ্যেও এক ধরনের ধর্মবিদ্বেষী চক্রান্ত খুঁজে পেলেন। বারবার এ ধরনের কথা বলে উনি (মমতা) বোধহয় নিজেকেই ছাপিয়ে যাচ্ছেন।”

সন্ন্যাসিনী হাসপাতালেই

শারীরিক অবস্থা আগের থেকে অনেকটাই ভাল রানাঘাটের স্কুলে আক্রান্ত সন্ন্যাসিনীর। মানসিক ধাক্কাটাও অনেকটা সামলে নিয়েছেন। সেই প্রেক্ষিতে বুধবার তাঁকে ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রানাঘাট মহকুমা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আরও কয়েকটা দিন হাসপাতালেই থাকতে চান বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেন বৃদ্ধা। সেই আবেদন মঞ্জুরও হয়। হাসপাতালের সুপার অতীন্দ্রনাথ মণ্ডল বৃহস্পতিবার বলেন, “ওই সন্ন্যাসিনী যত দিন এখানে থাকতে চাইবেন, আমরা তাঁর সেবার জন্য সব রকম ভাবে প্রস্তুত। আগের মতোই মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকেরা তাঁর দেখভাল করবেন।” এ দিনও চিকিৎসকেরা দু’বার ওই সন্ন্যাসিনীর শারীরিক পরীক্ষা করেছেন। সেই সঙ্গে চলেছে কাউন্সেলিংও। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর রক্তচাপ এবং পালস রেট স্বাভাবিক রয়েছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করেছেন। স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE