নমাজ: রোজা শেষে। নিজস্ব চিত্র
রমজানের আকাশে জোছনা ভরা চাঁদ। সারা দিন নিরম্বু উপবাস শেষে ইফতার ও মাগরিবের নামাজ পড়ার পরে বাড়ির ছাদে বসে আছেন সালারের মালিহাটি-কাদরা গ্রামের চিকিৎসক এম হাসান।
রমজানের জোৎস্না ধোয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে টাইম মেশিনে মাধবয়সী ওই চিকিৎসক যেন চলে গিয়েছেন চার দশক পিছনে। আনমনে তিনি শুনতে পাচ্ছেন সেই গলা, ‘জাগ বন্দে! জাগতে রহো! সেহরি কা ওয়াক্ত হো গয়া।’’
শীত, গ্রীষ্ম, কি বর্ষা যে সময়ই হোক না কেন, গভীর রাতে সেই হাঁকডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কর্ত্রীরা উনুন জ্বালিয়ে রান্না চাপাতেন সেহরির জন্য। রাতের তারাবির নামাজ পড়ার জন্য ইমামের আজান শুনে সম্বিত ফিরে পান এম হাসান। তিনি বলছেন, ‘‘সে এক সময় ছিল, জানেন। এখনও এই ফাঁকে ছাদে বসলে শুনতে পাই সেই ঘুম ভাঙানোর ডাক।’’
ইফতার করে সারা দিনের উপবাস ভাঙার পর মাগরিবের নামাজ। তার কিছুক্ষণ পরে তারাবির নামাজ। তারাবির নামাজ শেষে খাবার খেয়ে রাত ১০-১১টা নাগাদ ঘুমতে যাওয়া। সারাদিনের উপবাস ক্লিষ্ট শরীর ঘুমে তখন কাদা। কিন্তু রাত তিনটে নাগাদ সেহরির জন্য উনুন জ্বালাতে হবে রাত দে়ড়টা নাগাদ। বাড়ির ক্লান্ত-শ্রান্ত মহিলারা তো তখন ঘুমে কাদা। তখন মাইকও ছিল না পাড়ার মসজিদে মসজিদে।
তাই বলে তো রোজা রাখার জন্য সেহরির রান্না বন্ধ হতে পারে না। পাড়ার ১৫-২০ বছরের বালকদের নিয়ে ৮-১০ জনের একটা দল তৈরি করা হত। একটি গ্রামে এ রকম ৮-১০টি দল রাত দেড়টার সময় গ্রামের রাস্তায় বের হত। মাথায় ফেট্টি বাঁধা, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে হ্যারিকেন। কণ্ঠে ইসলামি গান। আর সময় হলেই রাস্তার পাশের বাড়ির দরজায় কড়া নেড়ে তাঁরা বলতেন, ‘‘সময় হয়ে গিয়েছে গো। ঘুম থেকে উঠে পড়ুন। সেহরি রাঁধুন।’’
এ তো পাড়ার ছেলেদের কথা। তাঁরা ছাড়াও গ্রামে গ্রামে রোজার মাসে ঘুম ভাঙানিয়ারা আসতেন বিহার থেকে। রোজা শুরুর দিনকয়েক আগে তাঁরা আসতেন। বিহারে ফিরতেন ইদের আগের সন্ধ্যায়। এম হাসান জানাচ্ছেন, গ্রামে তো তখন এখনকার মতো মাইক ছিল না। বিহার থেকে যাঁরা আসতেন, রাতে মসজিদে ঘুমোতেন। সেখানেই ইফতারি ও সেহরি করতেন। রাতদুপুরে লাঠি আর লণ্ঠন হাতে তাঁরা বেরিয়ে পড়তেন। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতেন, ‘জাগ বন্দে। সেহেরি কা ওয়াক্ত হো গয়া।’
ওই রাত জাগানিয়াদের ইদের আগের দিন বিভিন্ন বাড়ি থেকে নতুন পোশাক, সেমাই, চিনি, মশলা ও নানা খাবার দেওয়া হতো। মাইকের যুগে সে সব আজ বিবর্ণ ধূসর ইতিহাস মাত্র। কেবল মুর্শিদাবাদ জেলা নয়। মাইক প্রচলনের আগে তামাম দেশ জুড়েই ইফতারি ও সেহরির সময় নিয়ে নানা পদ্ধতি চালু ছিল। নদিয়ার ধুবুলিয়ার খাজুরি গ্রামের বৃদ্ধ হেকমত আলির চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও অর্ধশতাব্দী আগের সেহরি ও ইফতারের স্মৃতি এখনও অমলিন। তিনি বলেন, ‘‘ভোর রাতে বালক-যুবার দল কাঁসার ঘণ্টা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। ঢং ঢং আওয়াজ করে সেহরি রান্নার জন্য সবাইকে তাঁরা জাগাতেন। সেহরির ওয়াক্ত শেষের আগেও ঘণ্টা বাজিয়ে তারা সবাইকে সতর্ক করতেন।’’ সে সব এখন অতীত। সেহরির আগে এখন ঘুম ভাঙায় স্মার্টফোন। নানা কিসিমের রিংটোনে জেগে ওঠে পাড়া। তবে আজও কেউ কেউ শুনতে পান— জাগ বন্দে...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy