কান্দি, বড়ঞা ও মুর্শিদাবাদ— এই তিন কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে শরিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে ফ্রন্টধর্ম শিকেয় উঠেছে। ভোট পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক ও সিপিআই প্রকাশ্যেই বলছে, শুধু ওই তিনটি কেন্দ্রই নয়, অন্য কেন্দ্রগুলিতেও সিপিএম কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও অপ্রকাশ্যে কংগ্রেসের প্রার্থীর পক্ষ নেওয়াই শরিকদের অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দেবে। সম্ভাব্য ওই পরিণিতির জন্য বড় শরিক সিপিএম-কেই দুষছে ছোট শরিকরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য জবাবে বলছেন, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণা হোক। তারপর মন্তব্য করার বিষয়টি ভেবে দেখা যাবে।’’
কান্দি থেকে জিতে ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছর রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন সিপিআই নেতা ওয়াহেদ রেজা। ওই কেন্দ্রে বরাবর বামফ্রন্টের তরফে সিপিআই লড়াই করে আসছে। ২০০৬ সালে সেখান থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন কলকাতার নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন। ২০১১ সালের কান্দির সিপিআই প্রার্থী আইনাল হক কংগ্রেসের অপূর্ব সরকারের কাছে ৫৮১০ ভোটে হারেন। এ বার জোটধর্ম পালন করতে গিয়ে কান্দি সিপিআই-এর হাতছাড়া হয়েছে। কংগ্রেস সেখানে প্রার্থী দিয়েছে। জেলার রাজনীতির পরিসর থেকে সিপিআই কার্যত বিদায় নিল।
১৯৭৭ সাল থেকে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি ফরওয়ার্ড ব্লককে ছেড়ে দেওয়া হত। ওই কেন্দ্র থেকে জিতে দু’দফায় মন্ত্রী হন ফরওয়ার্ড ব্লকের লড়াকু নেত্রী ছায়া ঘোষ। ২০০৬ সালে ওই আসনে জেতেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক বিভাস চক্রবর্তী। ২০১১ সালে ফরওয়ার্ড ব্লককে মুর্শিদাবাদ ও রানিনগর—দু’টি আসন ছাড়া হয়। কংগ্রেসের কাছে দু’টি আসনেই অবশ্য হারে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থীরা। এ বারও ওই দু’টি আসন দাবি করে ফরওয়ার্ড ব্লক। ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর ঘোষণা অনুসারে, মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রটি ফরওয়ার্ড ব্লককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিভাস ফ্রন্টের প্রার্থী হলেও কংগ্রেস প্রার্থী শাওনী সিংহরায়ের পাশে দাঁড়ায় সিপিএম। ফলে বিভাসের জামানত থাকবে কিনা, তা নিয়েই দলের অন্দরে বিস্তর জল্পনা। জল্পনা বাস্তব হলে, জেলার রাজনীতি থেকে কার্যত মুছে যাবে ফরওয়ার্ড ব্লক। বিভাসবাবু বলেন, ‘‘শরিকদের ভরসা করতে পারেনি সিপিএম। তার বদলে ভরসা করেছে কংগ্রেসের উপর। আমাদের একা লড়তে হয়েছে। সেই অসম লড়াইয়ে আমাদের দলের সবস্তরের কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ময়দানে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটেও প্রয়োজনে আমরা একা লড়ব।’’ একই হুমকি ধেয়ে এসেছে ফ্রন্টের মেজো শরিক আরএসপি-র তরফেও।
সাংগঠনিক বিচারে এক সময় জেলায় সিপিআই এবং সিপিএমের থেকে বেশি শক্তিশালী ছিল আরএসপি। সে সব এখন ইতিহাস। এক সময় জেলায় একাধিক বিধায়ক ছিলেন। রাজ্য মন্ত্রিসভায় ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে আরএসপির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০১১ সালে আরএসপি ৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতে মাত্র ভরতপুরে। ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’র মতো আতান্তরে পড়ে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু শরিকের আব্দার মেনে ৫টি আসনে আরএসপি-র প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। পাল্টা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও ভরতপুরে কংগ্রেসের প্রার্থী দাঁড় করান। ধর্মসঙ্কটে পড়ে বিমান বসু কংগ্রেসের জেতা আসনেও শরিক দলের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও তৃণমূল স্তরের সিপিএম কর্মীরা অবশ্য আরএসপি-ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। ফলে ৫টি আসনের মধ্যে একটিতেও জিতবে কিনা, সেই সংশয় দেখা দিয়েছে খোদ আরএসপি-র অভ্যন্তরে। দলের জেলা কমিটির এক নেতা বলেন, ‘‘৫টি মধ্যে ৩টি— ভরতপুর, বড়ঞা ও নওদায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-এ আছি।’’ আরএসপি-র জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বারের ভোটে ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রে সিপিএমের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন। সিপিএমের এই ভূমিকা আমাদের ব্যথিত করেছে।’’
সেই ব্যথ্যার কারণে একটি আসনেও না কোদাল-বেলচা চিহ্নের প্রার্থীরা জিতলে না পারলে তা আরএসপি-র পক্ষে বেদনার কারণ হতে পারে। তার প্রভাব পড়তে পারে পঞ্চায়েত ও পুরসভার রাজনীতিতে। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘কোনও আসন না পেলে পরিষদীয় রাজনীতিতে অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিতে পারে ঠিকই। কিন্তু তারপর আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগঠন মজবুত করতে তো কোনও বাধা নেই!’’ এ হেন সঙ্কটে ফেলে দেওয়ার জন্য তাঁর হুমকি, ‘‘ফল ঘোষণার পর এ জেলার বামফ্রন্ট সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy