নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার সুদিন ফেরাতে ফের উদ্যোগী হল বঙ্গ বিবুধ জননী সভা।
নব্যন্যায়ের পীঠস্থান নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার গৌরব ম্লান হতে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন পর্বের শুরু থেকে। দেশের মানুষকে ইংরাজি শিখিয়ে সস্তায় কর্মী তৈরির কৌশল নেওয়ার পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকার সংস্কৃত শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সংস্কৃত শিক্ষার খাতে অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় পঠনপাঠন শিকেয় ওঠে। শিক্ষা শেষে ছাত্রদের উপাধিদানে দেখা দেয় নানা সমস্যা। বিদেশি শাসকের আনুকূল্য পাওয়া যাবে না বুঝে সংস্কৃতকে বাঁচাতে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ ১৮৮৬ সালে এক শিক্ষা সংসদ তৈরি করেন। দেশের প্রাচীন সেই শিক্ষা সংসদই নবদ্বীপ বঙ্গ বিবুধ জননী সভা।
বিদেশী শাসকের বিরোধিতার মুখে সংস্কৃত চর্চাকে দাপটের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল সে কালের বঙ্গ বিবুধ জননী সভা। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। বিদেশি শাসক গিয়েছে বহুকাল। তারপরেও সংস্কৃতের হারানো দিন ফেরেনি। সে আজ ‘মৃত ভাষা’। বেশ কিছু দিন হল বঙ্গ বিবুধ সভা নতুন উদ্যমে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সক্রিয় হয়েছেন। বছরভর শুরু হয়েছে নানা কর্মকাণ্ড। তারই অঙ্গ হিসেবে গত ৭ এবং ৮ মে সভার নিজস্ব ভবনে অর্থাৎ নবদ্বীপের কিংম্বদন্তি পণ্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের বা বুনো রামনাথের ভিটেয় অনুষ্ঠিত হয় সংস্কৃত ও প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন। সারা রাজ্যের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা জড়ো হয়েছিলেন দু’দিনের সম্মেলনে। সম্মেলন থেকে রাজ্যের বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থীরা দাবি তোলেন রামনাথের ওই জন্মভিটায় রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় গড়ে তোলার। এ বিষয়ে ওই সম্মেলন থেকে সকলের স্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি পাঠানো হয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২৯ এপ্রিল নবদ্বীপে সরকারি অনুষ্ঠানে এসে ঘোষণা করেছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নবদ্বীপে একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃত কলেজ গড়া হবে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি কমিটি বিষয়টি দেখছেন বলে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় জানান। ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় বঙ্গ বিবুধ জননী সভার সংস্কৃত ও প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলন থেকে সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় গড়ার দাবি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গ বিবুধ জননী সভার সম্পাদক নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অরুণকুমার চক্রবর্তী বলেন, “নবদ্বীপে সংস্কৃত কলেজের কথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। আমরা চাই সেই কলেজ বুনো রামনাথের জন্মভিটেয় হোক।” সভার মুখ্য উপদেষ্টা তথা নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নবদ্বীপে যে সংস্কৃত কলেজ গড়ার কথা বলেছেন তা এখানে হলেই সবথেকে ভাল হয়। যদি শহরের অন্য কোথাও কলেজ হয় সে ক্ষেত্রে প্রাচ্যবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করে এই কেন্দ্রে পড়ানো যেতে পারে। সমাজবিজ্ঞান, আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা, আয়ুর্বেদ চর্চা, শাস্ত্রচর্চা সবই প্রাচ্যবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।”
১৮৮৬ সালে পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহকে সভাপতি এবং অবসর প্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করে দেশের পণ্ডিত এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকদের নিয়ে সংস্কৃত চর্চাকে সুশৃঙ্খল রূপ দেওয়ার উদ্দেশে এই সভা তৈরি হয়। ১৮৯৭ সালে সভার সভাপতি হন তৎকালীন নদিয়ারাজ ক্ষিতীশচন্দ্র রায়। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই সভার সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯০৬ সালে। আমৃত্যু ওই পদে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহু পণ্ডিত এই সভার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের অন্যতম সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিজনকুমার মুখোপাধ্যায়, সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ প্রমুখ। এই সভার পরিচালনায় নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুসারে সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হত এবং ‘রত্ন’ উপাধি দেওয়া হত। পরবর্তী কালে সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ এই পাঠক্রম এবং পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করে। তবে ‘রত্নের’ বদলে ‘তীর্থ’ উপাধি দানের ব্যবস্থা করে। এক সময়ে বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে সভার ২৮টি কেন্দ্র ছিল। সংস্কৃত শিক্ষার সঙ্গে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও গ্রন্থ সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
সে সব গৌরব এখন অতীত। বুনো রামনাথের ভিটের ওপর ৩৮ কাঠা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে বেআইনি ভাবে। সামান্য কিছু এখন অবশিষ্ট আছে। আর আছে মূল্যবান গ্রন্থাগার আর পোড়োবাড়ির চেহারা নেওয়া ভবন।
সেটুকু সম্বল করে নবদ্বীপকে আবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড গড়ার লক্ষ্যে অসম লড়াইয়ে নেমেছে বঙ্গ বিবুধ জননী সভা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy