সর্বনাশের দিনলিপি। — ফাইল চিত্র
বৈশাখ জ্বলছে।
দিনমানের আগুন রোদে খেতি-বাড়ি থেকে হেঁশেলের দরমা শুকিয়ে খটখটে। সামান্য ফুলকিতেই ধাঁ-ধাঁ করে ধরে যাচ্ছে আগুন। মুহূর্তে গিলে ফেলছে ঘর-বার।
দমকলের হিসেবে, ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে। কারণ চারদিক খটখটে হয়ে থাকে। গ্রামে বহু বাড়িই বাঁশ, দরমা আর পাটকাঠির বেড়া দিয়ে তৈরি। চালও পাটকাঠি বা বিচুলির। বেশির ভাগ বাড়ির উঠোনে পাটকাঠি আর বিচুলি গাদা করে রাখা থাকে। বেশির ভাগ সময়ই উঠোনের এক কোণে খোলা জায়গায় থাকা উনুন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
আগুন নেভাবে কে? দমকল কোথায়, দমকল?
জেলায় হাতে গোনা যে কয়েকটি দমকল কেন্দ্র, তাদের শক্তি সামান্য। ইঞ্জিন যা-ও বা আছে কর্মী নেই। কে চালাবে গাড়ি, কে ছিটোবে জল?
২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তৃণমূল সরকার দমকল কেন্দ্র গড়ার আশ্বাস দিয়েছে নানা জায়গায়। শিলান্যাসও হয়েছে। ওই পর্যন্তই। কাজ আর বিশেষ এগোয়নি।
গত ২১ জানুয়ারি লালবাগ মহকুমা দমকল কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে মন্ত্রী জাভেদ খান বড় মুখ করে ঘোষণা করেন, ‘‘প্রতিটি ব্লকে একটি করে দমকল কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।’’ তারও কয়েক মাস আগে, কলকাতা থেকে রিমোট কন্ট্রোলে ডোমকল, রঘুনাথগঞ্জ ও ভগবানগোলায় প্রস্তাবিত দমকল কেন্দ্রের শিলান্যাস করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাস ছয়েক কেটে গেলেও একটি ইটও কোথাও পোঁতা হয়নি। ফল?
মুর্শিদাবাদ জেলার ৫টি মহকুমার মধ্যে ৪টিতে দমকল কেন্দ্র থাকলেও গোটা জেলা কার্যত জতুগৃহ হয়ে রয়েছে। জেলা সদর বহরমপুরের কথাই ধরা যাক।
বহরমপুরে জেলার প্রথম দমকল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয় কয়েক দশক আগে। আজও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়া হয়নি। ফায়ার ফাইটার অপারেটর থাকার কথা ৩৬ জন, রয়েছেন মাত্র ৫ জন। দুরাবস্থা সামাল দিতে অস্থায়ী ‘অক্সিলিয়ারি ফাইটার অপারেটর’ নেওয়া হয়েছে ১৬ জন। অর্থাৎ ৩৬ জনের বদলে আছেন ২১ জন। আগুন নেভানোর গাড়ি আছে ৩টি। তার জন্য ৩ শিফটে প্রয়োজন ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভার অন্তত ৯ জন। আছেন ৮ জন। স্টেশন অফিসার ও সাব অফিসার মিলে মোট ৮ জনের বদলে রয়েছেন মাত্র ৩ জন।
কান্দির অবস্থা আরও করুণ। ৩৬ জন ফায়ার অপারেটরের মধ্যে আছেন মাত্র ৮ জন। তার সঙ্গে ৭ জন অস্থায়ী অক্সিলিয়রি ফায়ার ফাইটার অপারেটর যোগ করলে দাঁড়ায় সাকুল্যে ১৫ জন। ৩টে গাড়ির জন্য প্রয়োজন অন্তত ৯ জন ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভার। আছেন মাত্র ৪ জন। ৩ জন স্টেশন অফিসার থাকার কথা। আছেন দু’জন। সাব অফিসার এক জনও না।
ধুলিয়ানে সব মিলিয়ে ৫২ জন কর্মী থাকার কথা, বদলে রয়েছেন ৩২ জন। ওই দমকল কেন্দ্রে আগুন নেভানোর ২টি গাড়ির জন্য প্রয়োজন ৬ জন ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভার। কিন্তু রয়েছেন মাত্র ২ জন। দু’টি টেলিফোন আছে। টোল ফ্রি নম্বরের ওই ফোনগুলি হামেশাই অচল থাকে। লালবাগে রয়েছে একটি টেলিফোন। ওই দমকল কেন্দ্রের অফিসার সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘‘কয়েক দিন ধরে টেলিফোন বিকল। কিছু দিন আগে নাগাড়ে চার দিন বন্ধ ছিল। এক্সচেঞ্জ অফিসে বললেও মেরামতির তৎপরতা দেখি না।’’
তারই ফল ভগবানগোলার সুলতানপুরের মতো বা গত বছর ডোমকলের তুলসীপুর-মস্তরাম সংলগ্ন এলাকায় গোটা গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া। শ’দড়েকে বিঘা পাকা ধান পুড়েছে। গত রবিবার সুলতানপুর ছাড়াও সাগরদিঘি থানার বারালা অঞ্চলের ভদ্রপুর গ্রামে দমকল বাহিনী পৌঁছনোর আগেই ১৪টি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।
নদিয়া একই মুদ্রার ও পিঠ। কৃষ্ণনগর স্টেশনের আটটি থানা এলাকার আগুন নেভানোর দায়িত্ব। কোনও কোনও এলাকার দূরত্ব ১০০ কিলেমিটারেরও বেশি। দু’টি ইঞ্জিন আছে। একটিতে ৭ হাজার লিটার জল ধরে। অন্যটিতে জল তোলার পাম্প। একটি ছোট ফোম ইঞ্জিন আছে, যা দিয়ে তেলের আগুন নেভানো যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক সঙ্গে দু’টো ইঞ্জিন নিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে অন্য কোন এলাকায় আগুন ধরলে কার্যত অসহায় দশা হয়। নবদ্বীপ, শান্তিপুর বা রানাঘাট থেকে গাড়ি এনে আগুন নেভাতে হয়।
করিমপুরে দমকলের দু’টি জল বহনকারী ইঞ্জিনের পাশাপাশি একটি পাম্প আছে। কিন্তু কর্মী সংখ্যা কম। অফিসার থাকার কথা ৬ জন, আছেন ২ জন। চালক থাকার কথা ৯ জন, আছেন ৪ জন। আগুন নেভানোর কর্মী থাকার কথা ৩৬ জন, আছেন ১৫ জন। করিমপুর দমকলের ওসি হেবজুর রহমান বলেন, ‘‘এত কম কর্মী নিয়ে তেহট্টের পাঁচটা থানা এবং মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থানা এলাকাও সামলাতে হয়।’’
রানাঘাট দমকল কেন্দ্রে ২টি ইঞ্জিন। কর্মীর সংখ্যা ৩২। এর মধ্যে চালকের সংখ্যা ৯ জনের বদলে মাত্র ৬ জন। নবদ্বীপ দমকল কেন্দ্র দেখে প্রধানত ওই শহর ও আটটি পঞ্চায়েত এলাকা। সেই সঙ্গে বর্ধমানের পূর্বস্থলী এবং নাদনঘাট থানার বিরাট এলাকার দায়িত্বও তাদের উপরে। তাদের হাতে আছে সবেধন নীলমণি একটি ৩০০০ লিটার জলধারণ করার মতো মাঝারি মাপের ইঞ্জিন। দু’টি ‘মেকানিক্যাল ফোম’ বহনকারী মোটরবাইক। আর একটি ৩৫ ফুট উচ্চতার মই। কিন্তু অফিসার তিন জনের জায়গায় আছেন এক জন। তাঁকে নিয়ে কর্মী সংখ্যা সাকুল্যে কুড়ি। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক। কোনও গ্যাস মুখোশ নেই। অগ্নিরোধী পোশাকও নেই।
এর উপরে ফোনের উৎপাত তো আছেই প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে। ফায়ার ব্রিগেডের ১০১ নম্বরে ফোন করে গালিগালাজ করা বা বাজে বকা প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা। কর্মীদের তা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই সব ফোনের জন্য জরুরি ফোন আটকে যায়, দমকলের দেরি হয় পৌঁছতে, জনরোষের মুখে পড়তে হয় কর্মীদের।
কৃষ্ণনগর দমকলের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘দিন কয়েক আগে মাঝরাতে এক মহিলা ফোন করে বললেন, আগুন লেগেছে। দু’টো ইঞ্জিন নিয়ে ছুটলাম। খানিক বাদে ফের ওই মহিলার ফোন— তাঁর নাকি মনে আগুন লেগেছে! বুঝুন! আমরা আবার ফিরে এলাম।’’
এত দিনে যে আরও বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়নি, সেটাই আশ্চর্যের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy