সম্বচ্ছর ‘তাহার দেখা নাই রে’! ভোটের ঢাকে কাঠি পডতেই তিন তো তখন এ তল্লাটের ‘জানালায় রোদ্দুর’। পদ্মার দু’টি শাখা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় কয়েক দশক আগে জেগে ওঠা নির্মলচরে আলো, পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- সহ সব ধরণের পরিষেবা বলতে সেই মধ্যযুগের। সেখানের হাজার ১২ মানুষের কাছে প্রতি বছরের মতো এ বারও ভোটের প্রাক্কালে রাজনৈতিক নেতারা ভোটের প্রচারে গিয়েছেন। আবারও যাবেন। চরের বাসিন্দাদের হাতে তৈরি কলাই-এর ইয়া বড়া রুটি নুন-লঙ্কা-লেবুর রসের চাটনি দিয়ে কুড়েঘরের তলায় বসে খেয়ে তাঁদেরই একজন সেজে সব দলের নেতারা প্রতিবারের মতো এ বারও সব ধরণের নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছেন। ওই ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের ভবিতব্য তবুও একই থাকবে। ভুক্তভোগীরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সেটাই বিশ্বাস করেন। তবুও আশার ছলনায় ভুলে তাঁরা ফের বুক বাঁধেন। আধুনিক সভ্যতার রোশনাই থেকে বহু দূর অন্ধকারে জল-জঙ্গল আর বালি আঁকড়ে পড়ে থাকা পদ্মাচরের মানুষ আশা পূরণের প্রত্যাশায় প্রার্থীদের পরম আত্মীয়ের মতো আদর আপ্যায়ন করে ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। যদি ভবি ভুলে!
তিন দশক আগে পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙনে চরকুঠিবাড়ি ও আখরিগঞ্জ নামের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জনপদ, ব্যাঙ্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মন্দির-মসজিদ, বাজার, দোতলা-তিনতলা ইমারত বাড়ি- সর্বস্ব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ জেলার মানচিত্র থেকে পুরোপুরি অবলুপ্ত হয়ে যায় চরকুঠিবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত। মুর্শিদাবাদ জেলার মোট ২৫৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা সরকারি খাতাতেই কমে দাঁড়ায় ২৫৪- তে। আখরিগঞ্জ খাতা-কলমে টিকে থাকলেও তার অধিকাংশই পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। নদী একদিক ভাঙলেও অপরদিক গড়ে তোলে। প্রাকৃতিক সেই নিয়মে মাঝপদ্মায় জেগে ওঠে কিলোমিটার নয়েক দীর্ঘ এলাকা। পদ্মার দু’টি শাখা নদী বেষ্টিত বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষা বিস্তৃত সেই চরের ৩ কিলোমিটার উত্তরে বাংলাদেশের রাজাসাহি জেলার রাজবাড়ি বাজার। আর ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে দেশের মূল ভূখণ্ডের রানিতলা থানার শিবনগর-আখরিগঞ্জ বাজার। ন’ কিলোমিটার বিস্তৃত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ওই ভূখণ্ডের ৭ কিলোমিটার এলাকা নাম নির্মলচর। পদ্মার ভাঙনে ভিটেমাটি খুইয়ে সবর্হারা মানুষ গুলো আশ্রয় নেয় মাঝপদ্মায় জেগে ওঠা সেই নির্মলচরে।
কোনও রকম রাসায়নিক ও জৈবিক সার ছাড়াই সেখানে হাজার দশেক বিঘা জমিতে কলাই চাষ ও কলাই উঠে গেলে বোরো ধানের চাষ হয়। প্রায় বিনা খরচায় উচ্চ-ফলনের ফলে চরবাসীর মুখে অনাবিল হাসি খেলে। সেই হাসি ফের কান্না হয়ে ঝরে ফি বছর বর্ষায় বানভাসি ও গ্রীষ্মে চরের বালিয়াড়িতে লু বইতে থাকায়। ভোটবাবুদের কথা কিন্তু বিনাবাক্যে তাঁরা মানতে নারাজ। অন্য বারের এবারও বিধানসভার ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস ও তৃণমূল সেখানে ভোট প্রচারে গিয়েছে। লোকসভা, বিধানসভা ও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের ভোটের মাঝে সময়ের ফারাক থাকে এক-দেড় বছর। ফলে চরের মানুষ এক-দেড় বছর অন্তর নেতাদের হাতের নাগালে পেয়ে ‘জানালায় রোদ্দুর’ ভেবে অতি প্রাচীন দাবি নতুন করে পূরণের আব্দার জানান।
শিবনগর-আখরিগঞ্জ লাগোয়া পদ্মার শাখানদী শুকিয়ে এখন হাঁটুজল। সেই হাঁটুজল পার হয়ে পার হয়ে কয়েকদিন আগে আগুনের মতো তেতে ওঠা বালুচর ভেঙে পায়ে হেঁটে ভগবানগোলার জোটপ্রার্থী সিপিএমের মহসিন আলি নির্মলচরের টিকলিরচর, পাইকমারি, মাঝচর, ঘোষপাড়া, মহিষমারি, পাতিবোনা, শয়তানপাড়া, চরমুনসুরপুর, ফকিরপাড়া, চরকৃষ্ণপুর, চরকুঠিবাড়ির-সহ সারা তল্লাটের বাড়ি বাড়ি ভোট চেয়েছে বেড়িয়েছেন। এই ভাবে তিনি হাজার বারো বাসিন্দার নির্মলচরের ৫টি বুথ এলাকা ঘুরেছেন। সব জায়গায় তাঁকে শুনতে হয়েছে এ জেলার নবগ্রাম থেকে পদ্মা পার হয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুত পৌঁছোতে পারলেও মাঝপদ্মার নির্মলচর আজও কেন অন্ধকারে? তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা হচ্ছে।’’ তাঁরই দলের দখলে থাকা স্থানীয় আখরিগঞ্জ পঞ্চায়েতের প্রধান খোসনেহার বিবির স্বামী মিল্টন শেখ বলেন, ‘‘নির্মলচরে সৌর বিদ্যুতের ৩২টি ইউনিট রয়েছে। তার মধ্যে ২২টিই অচল। বাকি ১০টি কত দিন সচল থাকে সেটাই চিন্তা।’’
প্রচারের ফাঁকে দুপুরের কাঠফাটা রোদে ক্ষণিকের বিশ্রাম নেন পাতিবোনায় পার্টিকর্মী অনিল মণ্ডলের বাড়ি। সেখানে হাল্কা খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকেই উঠল সমস্যার নানা প্রসঙ্গ— চরে ৬টি প্রাথমিক স্কুল থাকলে সপ্তাহে ৪ দিন বন্ধ থাকে। তাতে চাষের কাজ ঠিকঠাক না হলেও অবাধে বাংলাদেশে গরু পাচার হয়। উপস্বাস্থ্যা কেন্দ্র একটি আছে বটে, কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকে কয়েক বছর ধরে তার দরজা বন্ধ। গোটা তল্লাট জুড়ে পথ বলতে কংক্রিট ঢালাই মাত্র আধ কিলোমিটার। বাকিটা সব চরের বালুপথ। বিএসএফের অত্যাচারে চরে গরু চরানোতেও বড় হ্যাপা। মহসিন আলির মতো এ কথা শুনতে হয়েছে তৃণমূল প্রার্থী আবু সুফিয়ান সরকারকেও। মহসিন আলি বলেন, ‘‘টাকা খেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করে দিয়েছে তৃণমূল। তাই এই অবস্থা।’’ তৃণমূল প্রার্থী আবু সুফিয়ান সরকার বলেন, ‘‘ও সব বাজে কথা। কেবল বর্ষার সময় কয়েক মাস শিক্ষক আসেন না।’’
নির্মলচরের উত্তরে ৩ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের রাজশাহি শহরে ও দক্ষিণে ৫ কিলোমিটার দূরে রানিতলা শহরে একুশ শতকের সভ্যতা এসে থমকে গিয়েছে। সেখান থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরের নির্মলচর ডুবে আছে মধ্যযুগের আঁধারে। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জ দেওয়া থেকে শুরু করে ধান থেকে চাল করার, গম থেকে আটা করা, মুমূর্ষু রুগীর চিকিৎসার প্রয়োজনে বর্ষায় ৫ কিলোমিটর নৌপথ আর গ্রীষ্মে হেঁটে নির্মলচরকে উঠে আসতে হয় আখরিগঞ্জ-রানিতলায়। বিদ্যুত, আলো, পথ, স্বাস্থকেন্দ্র বিষয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই পৃথক ভাবে বলেন, ‘‘ক্ষমতায় এলে সমস্যার সমাধান করা হবে।’’ প্রতি ভোটে যেমন শোনা যায়! নির্মলচর তবু এ বারও ভোট দেবে নির্মলচর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy