যানজটে হাঁসফাঁস। — নিজস্ব চিত্র
‘ক্যানসার’ শহরের। যন্ত্রণাময় নাগরিক জীবন।
ক্যানসারের নাম যানজট। শহরের নাম বহরমপুর।
কেমন সে যান যন্ত্রণা?
যে কোনও প্রান্ত দিয়ে ঐতিহাসিক এই শহরে ঢুকতে গেলেই মালুম হচ্ছে। বেলডাঙ্গার দিক দিয়েই হোক, বা জঙ্গীপুর বা কান্দির দিক দিয়েই হোক। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে শহরের কেন্দ্রস্থল বাস স্ট্যান্ড, বা রেল স্টেশনে পৌঁছতে গেলে ঠোক্কর খেতে হচ্ছে পদে পদে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যান-জটের ঢেউয়ে আন্দোলিত হচ্ছে শহরের অন্যান্য রাস্তা। ভিড়ে মোড়া বড় রাস্তা এড়াতে গিয়েই ঘটছে বিপত্তি। দিনের ব্যস্ত সময়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে শহরের ট্র্যাফিক ব্যবস্থা।
তার ফলে যা যা ঘটছে, তাকেই ‘ক্যানসার’ বলে চিহ্নিত করেছেন শহরের আম নাগরিক থেকে যান-চালকেরা, এমনকী ট্র্যাফিকের দায়িত্বে থাকা পুলিশও।
আসল সমস্যা যদি হয় যানজট, তা হলে সব থেকে বড় সমস্যা তামাম প্রশাসনের ঠুঁটো হয়ে বসে থাকা। সব মিলিয়ে থাবা বসাচ্ছে রোগ। আর উপযুক্ত দাওয়ায় দেওয়ার কথা যাদের, তারাই নির্বিকার। ফলে ক্ষোভ জমছে সাধারণ মানুষের।
এবার এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক শহরের ট্র্যাফিক মানচিত্রের দিকে।
শহরের বুক চিড়ে চলে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের একমাত্র গুরুত্বপুর্ণ রাস্তা এটিই। শহরের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য জাতীয় সড়ক থেকে একাধিক রাস্তা ঢুকেছে শহরের মধ্যে। তার ফলে জাতীয় সড়কের যানজটের ধাক্কা সইতে হচ্ছে শহরের প্রায় সব রাস্তাগুলিকে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সারা বছর যানজট লেগেই রয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ পুজো-পার্বণে জেলা সদর বহরমপুরে কেনাকাটা করতে আসেন। কিন্তু যানজটের কারণে বহিরাগত ক্রেতার সংখ্যা এবার অর্ধেক হয়ে গিয়েছে বলে বহরমপুর ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্তীর অভিযোগ।
তিনি জানান, গত এক বছর ধরে লাগাতার যানজটের কারণে শহরের ব্যবসা মার খাচ্ছে। যে কোনও প্রান্ত দিয়ে বহরমপুর শহরে ঢুকতে বাড়তি দু’-তিন ঘন্টা সময় লাগছে। তার উপরে মাত্রাতিরিক্ত গরম। এই গরমের মধ্যে যানজটের ফলে বাসের মধ্যে চুপ করে বসে থাকতে হচ্ছে তাঁদের। ফলে তিতিবিরক্ত হয়ে তাঁরা বহরমপুর থেকে কেনাকাটা করা ছেড়েই দিয়েছেন। তার প্রভাব পড়ছে বহরমপুরের বাজার অর্থনীতির উপরে।
খাগড়া এলাকার এক ব্যবসায়ী জানালেন, জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সকালের দিকে এসে বিভিন্ন বাজার ঘুরে কেনাকাটা সেরে দুপুরের দিকে ছেড়ে চলে যাওয়া ক্রেতার সংখ্যা বহরমপুর শহর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। মূলত যানজটের কারণেই ওই ক্রেতা-শ্রেণি বহরমপুর শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
বহরমপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে জামা-কাপড়ের দোকানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু বহিরাগত ক্রেতার সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। বহরমপুরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘ব্যবসা হচ্ছে মূলত শহর ভিত্তিক। ফলে ইদ-পুজোর দিকে তাকিয়ে যারা মোটা টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।
ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের উত্তরপাড়া থেকে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ের ভাকুড়ি মোড় পর্যন্ত যানজট নিত্যদিনের ঘটনা।
এক সময়ে বহরমপুরের বাসিন্দাদের পছন্দের তালিকায় ছিল টুকটুক বা টোটো। শহরের শিরা উপশিরা দাপিয়ে বেড়ানো এই টোটোই এখন শহরের গতি স্তব্ধ করে দিচ্ছে। টুকটুকের দাপটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা, ট্রেকার স্ট্যান্ড চত্বর, স্বর্ণময়ী বাজার, লালদিঘির পাড় বরাবর রাস্তা, গোরাবাজার নিমতলা মোড়, বহরমপুর রেল স্টেশন চত্বর, কাদাই, খাগড়া, নতুন বাজার এলাকায় ব্যাপক হারে যানজট হওয়ার পিছনে রয়েছে টুকটুকের দাপট।
বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গেটের সামনের রাস্তা আটকে টুকটক দাঁড় করিয়ে যে ভাবে যাত্রী ওঠানামা করে, তাতে রোগী নিয়ে যাতায়াতে অসুবিধের মুখে পড়তে হয়। রোগী নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স দীর্ঘ ক্ষণ দাঁডিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। পুলিশ ও প্রশাসনের কোনও হুঁশ নেই। যদিও হাসপাতালের গেটের মুখের যানজট নিয়ন্ত্রণে বহরমপুর সিভিক পুলিশ রয়েছে। কিন্তু টুকটুক চালকদের বেপরোয়া আচরণের সামনে পুলিশ কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ।
যানজট রুখতে টুকটুক চালকদের সঙ্গে আলোচনা করে ‘রুট’ ঠিক করে দেওয়ার ব্যাপারে পুরসভা ও প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওই বৈঠক হয়নি। আইএনটিইউসি অনুমোদিত বহরমপুর টুকটুক সমিতির সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ দে বলেন, ‘‘শহরের যানজট রুখতে হলে বেশি জরুরি, বাইরে থেকে রোজ কয়েক হাজার টুকটুককে শহরে ঢোকা বন্ধ করা। সে ব্যাপারে পুলিশ ও প্রশাসন সকলেই নীরব।’’
বহরমপুর বাস টার্মিনাসে ঢোকার আগেই ট্র্যাফিক আইল্যান্ডে বাস-লরি-ট্রেকার-ম্যাজিক ভ্যান-টুকটুক-মোটরবাইক সব মিলিয়ে এক অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটে। একটানা বেজে চলা হর্নের দাপটে কানে তালা ধরার অবস্থা। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখের ওই জট পঞ্চাননতলামোড় হয়ে চুঁয়াপুর মোড়ের দিকে আছড়ে পড়েছে। যানজটের কারণে গির্জার মোড় হয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সেতুর উপরে থেকে খাগড়া রেলগেটের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
বহরমপুরের সবচেয়ে ব্যস্ত ও জনবহুল সমবায়িকা মোড় থেকে বাসস্ট্যান্ড যাতায়াতের রাস্তার দু’পাশে হকারদের রকমারি দোকান। এতে রাস্তা যেমন সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে, তেমনি স্বাভাবিক যাতায়াতও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে রিক্সা, টুকটুক, মোটরবাইক, সাইকেল, পথচারীদের ভিড়ে ওই রাস্তা সর্বক্ষণের জন্য ব্যস্ত থাকে। ওই যানজট ঠেলে বাসস্ট্যান্ডের ভিতর থেকে বাস বের করতে গিয়ে ওই যানজট আরও পাকিয়ে যায়। নিত্য বাস যাত্রী সমিতির পক্ষে তৌসিফুল ইসলাম তুহিন বলেন, ‘‘যানজটে বাস বের হতে পারে না। গরমের মধ্যে বাসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। অফিস-স্কুল-কলেজে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়।
বহরমপুরের এসডিও দিব্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শহরের যানজট নিয়ে আমরাও চিন্তিত। পুজোর আগে আমরা সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে সমস্যা সমধানের চেষ্টা করছি।’’ বহরমপুর থানাক আইসি শৈলেন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের হাতে কর্মী অনেক কম। সিভিক পুলিশ দিয়েই ণাদের চালাতে হচ্ছে।’’
আলোচনা আর বৈঠকে কি কর্কট রোগ থেকে মুক্তি পাবে শহর? জবাব চায় আম জনতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy