চিঠিটা এল, জল শুকিয়ে যাওয়ার পরে।
সৎকারের দীর্ঘ পর্ব মিটে গেলে, সকলে ফিরে এসেছে, চাপা কান্না নিয়ে বাড়িটা যখন আপাত সহজ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, গেটের গায়ে সাইকেল হেলান দিয়ে ডাকবাক্সে চিঠিটা ফেলে গেল পিওন।
খেয়াল করেনি কেউ। নজরে পড়েছিল বাড়ির ছোট্ট মেয়েটির। ‘চিঠি এসেছে’, বলে গুম হয়ে থাকা দেওয়ালে এক মুঠো অস্থিরতা ছড়িয়ে এক ছুট্টে ধূসর খামটা নিয়ে আসতেই সকলে হুড়মুড়িয়ে পড়ল তার উপরে, খাম থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল তিন লাইনের চিঠিটা— ‘তার পেলাম এখনই। রাতের গাড়ি ধরছি। হয়ত কাল পৌঁছব।’
টেলিগ্রাম ছুটেছিল ক’দিন আগে— ‘দ্রুত এস। কেয়া গুরুতর অসুস্থ।’ গলির প্রান্তে বোসবাবুদের বাড়ি পাড়ার একমাত্র ফোন। হাসপাতালের বিছানায় ঝুঁকে পড়া মুখ দেখলেই এ ক’দিন নিভু নিভু গলায় কেয়া জিজ্ঞেস করত, ‘...ফোন করেছিল?’ প্রশ্নটা এড়ানো বড় কঠিন হয়ে পড়ছিল ক্রমেই। তবু বলতেই হত, ‘‘এই এল বলে, ব্যস্ত তো, সময় পেলেই করবে হয়ত।’’
শেষের দিন কয়েক সেই প্রশ্নটাও হারিয়ে গিয়েছিল। বোবা চোখে সেই জিজ্ঞাসা নিয়েই হয়ত তাকিয়ে থাকত কেয়া। হাসপাতালের কড়িকাঠে তার একটা নিঝুম উত্তর খুঁজত কেউ কেউ।
অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। প্রশ্নটা বেপথু হাওয়ার মতো মাথা কুটছিল এ ক’দিন। সকলেই জানত, স্বভাবটা এমন নয় কাঞ্চনের। বরং, উল্টোটা।
সামান্য জ্বর-জালির খবর শুনলে, ডাক্তার-বদ্যি-পথ্য নিয়ে সে একেবারে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে এমন উতলা হয়ে উঠত যে বাড়ির মহিলারা মুখ টিপে বলতেন, ‘ছেলে বড় নরম গো, বউকে বড় জ্বালাবে!’ সে ছেলের এমন নিরুত্তর হয়ে যাওয়া দেখে মেঘ জমেছিল শহরের গলিতে।
বন দফতরের চাকরি নিয়ে তরাইয়ের পাহাড়তলিতে চলে যাওয়ার পরেও দিন দশেক অন্তর তার উদ্বেগ ভরা চিঠি আসত— ‘সকলে ভাল আছে তো?’ কাঞ্চনের এমন নরম মন দেখে দেখেই কেয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা নিশ্চিৎ ভাবে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিলেন দু’বাড়ির লোক। ফাগুনের মাঝামাঝি তাদের বিয়ের দিনটাও পাকা করে ফেলতে দেরি করেননি তাঁরা।
বন্ধুরা চিমটি কাটতে থাকল, ‘আবার ফাগুন কেন, মাঘেই তো কেয়া-কাঞ্চন যোগ রয়েছে, ভ্যালেন্টাইন ডে!’ সে বড় পুরনো সময়, সত্তরের দশক। সাহেবি প্রেম দিবসের কদর তখনও তেমন ঘন হয়নি যে!
সেই টানাপড়েনের মাঝেই এক সন্ধের অকাল বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে ঘাই মারা মাছের মতো রোগটা আস্টেপৃষ্টে ধরল কেয়াকে। সে খবর বনের গহীনে পাঠানো হয়নি, বড়রা বললেন, ‘শুধু শুধুই উতলা করা মানুষটাকে!’
কেয়া যখন ক্রমেই তলিয়ে যেতে থকল, ডাক্তার তাঁর চশমার গভীর কাচ মুছে বললেন, ‘ভাল বুঝছি না হে’, খবর ছুটল তখনই। কিন্তু শহরের তস্য গলি থেকে মাঠ-নদী-মেঘ ঠেলে সে খবর পাহারতলির দিকে ভাসতেই থাকল!
ডাকপিওনের অলস সাইকেল যে দিন সে তার পৌঁছে দিল, সে রাতেই শহরের ট্রেন ধরল কাঞ্চন।
রাতের নামহীন নক্ষত্রের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে কাঞ্চন ঠাওরই করতে পারল না— আজ, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালবাসার সকালে চুপি চুপি দূরপাল্লার এক ট্রেনে রাতের আকাশের দিকে মেঘ-পিওন হয়ে পাড়ি দিয়েছে কেয়াও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy