ঘামে সপসপ করছে দুধসাদা পাঞ্জাবি। গলায় তৃণমূলের উত্তরীয়। পায়ে নীল-সাদা স্নিকার্স।
রুমাল বের করে ঘনঘন ঘাম মুছছেন তিনি। মাঝে-মাঝেই চুমুক দিচ্ছেন কচি ডাবে।
আর নিয়ম করে ইনসুলিন।
গত বার গোঁজের গুঁতোয় মাত্র ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে তিন নম্বরে দৌড় শেষ করেছিলেন তিনি। এ বার সেই গৌরীশঙ্কর দত্ত বেশ তেজের সঙ্গে বলছেন, ‘‘জয় নিশ্চিত।’’
তেজের কারণটা তেহট্টে ফুল-ঘাস-পাতা সকলেরই জানা। জেলা তৃণমূলের ‘কাপ্তান’ গৌরী দত্ত তেহট্টে থাকেন না। এলাকার নেতাও নন তিনি। কিন্তু তিনি দুইয়ে দুইয়ে যোগ করতে জানেন। ২০-র সঙ্গে ৩২ যোগ করলে যে ৫২ হয় এবং তা যে ৪৩-এর চেয়ে বেশি, তা-ও জানেন।
তাই তিনি ‘নিশ্চিত’।
অঙ্কটা গোপন কিছু নয়। গত বার ৩২ শতাংশ ভোট কেটে নিয়ে যিনি গৌরীবাবুকে থার্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জার বগিতে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে ‘দিদি’ কালীঘাটের বাড়িতে ডেকে খুব নরম-গরম দিয়েছেন। প্রথমে তো দল থেকে তাড়িয়েই দিয়েছিলেন (যেমন প্রায়ই দেওয়া হয় একে-তাকে)। পরে ঢোঁক গিলে ফিরিয়ে নিয়েছেন (যেমন প্রায়ই নেওয়া হয়)।
গত বার ‘নির্দল’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া তাপস সাহা এ বার গৌরীবাবুর সঙ্গে আছেন। তেহট্ট তিনি চেনেন হাতের তালুর মতো, বুথ বাই বুথ। পাশের পলাশিপাড়ায় রাঙাজমিতে ঘাসফুল ফোটাতে তাঁকে পাঠিয়ে দিয়ে জেলা সভাপতির হাতে সাজানো বাগান তুলে দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তাপসকে ডেকে দিদি বলে দিয়েছেন, ‘তোকে কিন্তু তিনটে কেন্দ্র জেতাতেই হবে। তেহট্ট, পলাশিপাড়া, করিমপুর। দায়িত্ব তোর।’
তাপস মাথা নেড়েছেন।
গৌরী তাই ‘নিশ্চিত’। নিশ্চিন্ত।
শুক্রবার ভরদুপুরে জ্বালাপোড়া রোদেই তাই গৌরী দত্তের মুখের হাসি শুকোয়নি। হুডখোলা জিপ থেকে হাসিমুখে হাত নেড়ে প্রচারে ঘুরেছেন নাটনায়। হেডমাস্টারের বাড়ির খুব কাছে। নাটনা হাইস্কুলের হেডমাস্টার রণজিৎ মণ্ডলই গত বার ৪৩ শতাংশ ভোট শুষে সিপিএমের বিধায়ক হয়েছিলেন। সেখানেই প্রচার। গৌরী দত্তের ঠোঁটে তাই বাড়তি হাসি।
কী মনে হচ্ছে এ বার?
হাসতে-হাসতে গৌরীবাবু বলেন, ‘‘এ বারের পরিস্থিতি আলাদা। গত বার যাঁরা তাপসের হয়ে ভোটে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরাই এ বার আমার হয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন।’’
তা তো বটেই। ২০১১ সালে যে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা পথে-ঘাটে গৌরীবাবুর নামে নানা অকথা-কুকথা বলে বেড়িয়েছেন, মাইক ফুঁকে বলে গিয়েছেন, ‘বহিরাগত গৌরী দত্তকে ভোট নয়’, তাঁরাই এখন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলছেন, ‘গৌরীদার মতো লোক হয় না, দলে দলে ভোট দিন।’
‘গৌরীদা’কে তা হলে জিতিয়েই দিচ্ছেন?
মাথা নাড়়ছেন তাপস— ‘‘আমি জেতানোর কে? জেতাবে তো মানুষ।’’ বলেই একটা লম্বা শ্বাস টেনে কর গোনা শুরু— ‘‘এই তো, দেখুন না, দিঘলকান্দি, নারায়ণপুর ১ আর ২, নন্দনপুরে গৌরীদা লিড পাবে। তেহট্ট কানাইনগর, ছিটকা, বেতাই ২ একটু চাপ হতে পারে। তবে এখনও অনেক সময় রয়েছে। ও দিকে শ্যামনগর, রঘুনাথপুর...।’’
পঞ্চায়েত ধরে ধরে বলে দিচ্ছেন?
‘‘বুথ ধরে ধরে বলে দিতে পারি’’ —হাসছেন তাপস। তা হলে তো এই তেহট্টেই দাঁড়াতে পারতেন নিজে? সঙ্গে-সঙ্গে শট সামলে তাপস প্রায় রাবুল দ্রাবিড়— ‘‘ধরেই নিয়েছিলাম, আমায় প্রার্থী করা হবে না। তেহট্টে যে দাঁড়াবে, তার জন্য খাটব। শেষে আমায় পলাশিপাড়ায় দেওয়া হল, গৌরীদাকে এখানে। গত বারের কথা আমরা কেউই মনে রাখতে চাই না।’’
জমাট ডিফেন্স!
তাঁদের ‘গৌরীদা’ তাই নিশ্চিন্ত হয়ে কখনও জিপের উপর থেকে হাত নাড়ছেন। কখনও জিপ থেকে নেমে সটান ঢুকে যাচ্ছেন গেরস্তের বাড়ি। কেউ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। চৈত্রের বিকেলে বাড়ির ছাদ থেকে উড়ে আসছে গাঁদার পাপড়ি।
কিন্তু কিছু ফুলে চোরা কাঁটা থাকে। বুঝতে না বুঝতেই হাতে বিঁধে যায়।
জোড়াফুলের নিশ্চিন্তির হিসেবও তেমনি। এই বিধানসভায় মোট ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের (তেহট্ট ১ ব্লকে ন’টি ও করিমপুর ২ ব্লকে চারটি) ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দশটিই তৃণমূলের কব্জায়। তেহট্ট ১ পঞ্চায়েত সমিতিও তাদেরই দখলে। তাপস তাই হাসিমুখে কর গুনছেন। কিন্তু ২০১৩ সালের ওই ভোটেই যে সিপিএম করিমপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল বা এই বিধানসভা এলাকায় পড়া জেলা পরিষদের পাঁচটি আসনই পকেটে পুরেছিল, তা বলছেন না।
পরের বছর, লোকসভা নির্বাচনে ২০১১-র তুলনায় ১৮ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছিল বিজেপি। ১১ শতাংশ ভোট খুইয়েছিল সিপিএম। পড়তি হাওয়ায় এ বার তারা যদি ফের ২২ থেকে চার শতাংশে নেমে আসে, ১৮ শতাংশ ফিরবে কার ঝুলিতে? দুই শিবিরই তীর্থের কাকের মতো চেয়ে বসে আছে। দু’পক্ষেরই আশা, দাঁওটা তারাই মারবে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, যার ভোট তার কাছেই ফিরবে তা হলে কিন্তু গৌরীবাবুর হাসি শুকিয়ে যেতে পারে।
লোকসভা ভোটের অঙ্কের নিরিখে সিপিএমের ৩২ শতাংশের সঙ্গে কংগ্রেসের ৫ শতাংশ এবং বিজেপি-ফেরত ১১ শতাংশ যোগ দিলে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। সেখানে তৃণমূলের ৩৯ শতাংশের সঙ্গে বিজেপি-ফেরত বাকি ৭ শতাংশ যোগ দিলে দাঁড়ায় ৪৬-এ। পাক্কা দু’শতাংশ এগিয়ে থাকেন লাল বাহিনীর হেডমাস্টার।
তবে লড়াইটা এতটাই কান ঘেঁষা, এত রকম যদি-কিন্তু তাতে, যে কেউই এই সব হিসেব আঁকড়ে বসে নেই। বরং গৌরীবাবুর মতোই রোজ সকালে সিপিএম-কংগ্রেস কর্মীদের একজোট করে বেরিয়ে পড়ছেন রণজিৎবাবুও। শুক্রবার কড়ুইগাছি আর শ্যামনগরে একদফা প্রচার শেষে দুপুরে এক কমরেডের ঘরে নিরিমিষি পদ দিয়ে দু’গাল ভাত খেয়েছেন।
ছোট্ট একটা ঢেঁকুর তুলে শান্ত গলায় হেডমাস্টার বলছেন— ‘‘গত বার কী হয়েছিল, ওঁরা সব ভুলে যেতে পারেন। কিন্তু মানুষ সব মনে রেখেছে। কেউ বোকা নয়। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে যা বুঝছি, মানুষ এই সরকারের উপরে তিতিবিরক্ত।’’
দেওয়াল লিখন থেকে ফেস্টুন-ব্যানার, সবেই তো তৃণমূল এগিয়ে?
রণজিৎবাবু পাল্টা বলছেন, ‘‘ও সব দিয়ে ভোট হয় না কি? তা হলে তো মিটেই যেত!’’ তা হলে কি দিয়ে ভোট হয় তেহট্টে? শুধুই তাপস দিয়ে?
এ বারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন গৌরী দত্ত— ‘‘এর মধ্যে কোথাও তাপস নেই। আমিও নেই। আছেন এক জনই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
গৌরীবাবু তাই নিশ্চিন্ত।
(সহ প্রতিবেদন— কল্লোল প্রামাণিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy