Advertisement
E-Paper

চেনা হাসপাতালে অচেনা হাহাকার

ওয়ার্ড থেকে মর্গ জুড়ে শুরু হয় জখম ও আহতদের বাড়ির লোকজনের তুমুল ছোটাছুটি। কেউ ওয়ার্ডে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, তাঁদের বাড়ির লোকটা কেমন আছে। সেখানে গিয়ে কোনও সন্ধান না পেলে ফের তিনি ছুটেছেন মর্গে।

সামসুদ্দিন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৫৫
স্বজন হারিয়ে। ডোমকলে। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম

স্বজন হারিয়ে। ডোমকলে। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম

চেনা হাসপাতাল। অথচ সকাল থেকেই বিলকুল বদলে গেল মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেনা চেহারাটা।

সোমবার সকালে দৌতলাবাদের বালিরঘাটে বাস দুর্ঘটনার খবর পৌঁছতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়ে যায় এই হাসপাতালে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে বড় হাসপাতাল বলতে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল। ফলে জখম কিংবা মৃতদের সেখানেই নিয়ে আসার কথা। তাই চিকিৎসক থেকে নার্স, হাসপাতালের কর্মী সকলেই প্রস্তুত ছিলেন।

দুপুরের পর্যন্ত এক এক করে দশ জনকে নিয়ে এসে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। নিয়ে আসা হয় চার জনের দেহও। বিকেলের পর থেকেই এক এক করে আসতে শুরু করে আরও প্রায় ৩২টি দেহ।

এ বার হাসপাতালের চেহারা আরও বদলে যায়। ওয়ার্ড থেকে মর্গ জুড়ে শুরু হয় জখম ও আহতদের বাড়ির লোকজনের তুমুল ছোটাছুটি। কেউ ওয়ার্ডে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, তাঁদের বাড়ির লোকটা কেমন আছে। সেখানে গিয়ে কোনও সন্ধান না পেলে ফের তিনি ছুটেছেন মর্গে।

হাসপাতালের কর্মীদের ভরসায় না থেকে কেউ কেউ নিজেই উল্টে নিচ্ছিলেন মৃতদের তালিকা। কেউ নাম দেখে সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ আবার সেখানে নাম না দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে ফের দৌড় দেন ওয়ার্ডের দিকে।

করিমপুরের দাঁড়েরমাঠের বাসিন্দা বিভাস বিশ্বাস ও তাঁর দাদা বিকাশ বিশ্বাস দু’জনেই ওই বাসেই বহরমপুর যাচ্ছিলেন। অন্য একটি দুর্ঘটনায় বিভাসের পা ভেঙেছে। চিকিৎসার জন্য বহরমপুর যাচ্ছিলেন। বিভাস এক পায়ে কোনও রকমে সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বিকাশের কোনও খোঁজ মেলেনি।

বিভাস বলছেন, ‘‘বাসের পিছনের দিকে দাদা ও আমি বসেছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ করে বাসটি জলে পড়ে যায়। আমি কোনও রকমে সাঁতার কাটতে শুরু করি। পরে কিছু লোকজন আমাকে উদ্ধার করে।’’ বর্তমানে তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু সোমবার রাত পর্যন্ত তাঁর দাদা বিকাশের কোনও খোঁজ মেলেনি।

বিকাশের মেয়ে সুদীপ্তা এ দিন খবর পেয়ে প্রথমে দৌলতাবাদ ও পরে মেডিক্যাল কলেজে আসেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত জখম ও মৃতদের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তার কোনওটাতেই বিকাশের নাম মেলেনি। খুঁজে পাওয়া যায়নি জলজ্যান্ত লোকটাকেও।

এ দিন হাসপাতালে মর্গের সামনে বিকেলেই টাঙানো হয় মাইক। তৈরি করা হয় অস্থায়ী মঞ্চ। সেখান থেকেই নাগাড়ে নানা ঘোষণা চলেছে গভীর রাত পর্যন্ত। কখনও মাইক ডুকরে উঠেছে, ‘সৌমিত্র নন্দীর দেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর পরিবারের লোককে অনুরোধ করা হচ্ছে।’ কখনও আবার শোনা গিয়েছে, ‘সুরাইয়া খাতুনের বাড়ির লোক কে আছেন?’

সুরাইয়ার বাড়ির লোকজন এগিয়ে গেলেন দু’বছরের ফুটফুটে মেয়েটার দেহ আনতে। সারাদিন এই খবরটাই গোপন রাখা হয়েছিল সাজেদা বিবির কাছে। এরপরে সকলেই ভেবেছিলেন সাজেদা বুঝি সত্যিটা জেনে গেল! কিন্তু সাজেদার ঘর পর্যন্ত মাইকের আওয়াজ পৌঁছয়নি। সাজেদার পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, ‘‘এ খবর আর কতদিন চেপে রাখা যায়! কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা ওকে কিছু জানাতে চাইছি না।’’ সুরাইয়া সাজেদার ছোট মেয়ে। আলিবক্স স্বামী। এ দিন তিনি স্বামীকে চিকিৎসার জন্যই নিয়ে আসছিলেন বহরমপুরে। তিনি কোনওরকমে বেঁচে গেলেও মেয়ে ও স্বামী মারা যান।

এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে ফিরে জেলাশাসকের অফিসে বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন। সেখান থেকে সন্ধ্যায় তিনি আসেন হাসপাতালে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের পাশে আছি। চিকিৎসক থেকে সকলেই কথা দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ময়নাতদন্ত শেষ হবে, ততক্ষণ তাঁরা কেউ হাসপাতাল ছেড়ে যাবেন না। করিমপুরের অনেকেই মারা গিয়েছেন। সেখানকার বিধায়ক মহুয়া মৈত্র এখানে থাকলেন। থাকলেন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীও।’’

ওই দু’জনেই এ দিন হাসপাতালে ঠায় বসেছিলেন। ছিলেন পরিবহণ দফতরের সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা।

Murshidabad Bus Accident Murshidabad Medical College Hospital Injured Death
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy