Advertisement
০৫ মে ২০২৪

উল্টোরথের মেলায় জমজমাট বিকিকিনি

নবদ্বীপে উল্টোরথের মেলায় গোপাল দত্ত।

নবদ্বীপে উল্টোরথের মেলায় গোপাল দত্ত।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৪ ০১:১০
Share: Save:

পুতুল নেবে গো ...পুতুল

দু’দিন আগে তৃতীয় শ্রেণির অসীম দত্ত তার ক্লাসের বন্ধুদের উল্টোরথের মেলায় নিমন্ত্রণ করেছিল। অসীমের বাপ-ঠাকুর্দা তিন পুরুষের মাটির পুতুলের কারিগর। কাদামাটি নিয়ে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা বছর আটেকের অসীমও এখন দিব্যি ‘বর-বউ’ পুতুলে রং করতে পারে। এবার রথের মেলায় অসীমের রং করা পুতুল বিক্রিও হয়েছে। অসীম ভেবেছিল, উল্টোরথের মেলায় তার নিজের হাতের রং করা জগন্নাথ দেখিয়ে স্কুলের বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেবে। রথের পরের দিন থেকেই বাবার কাজের ফাঁকে সে আর তার দিদি দু’জনে মিলে বেশ কয়েকটা জগন্নাথ বানিয়েছিল বন্ধুদের জন্য। কিন্তু অসীমের বন্ধুরা কেউ তার মাটির জগন্নাথ নেয়নি। ‘মাটির ডেলা নিয়ে কী করবি?’ বলে বন্ধুদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বাবা-মা। মনখারাপ হয়ে গিয়েছে অসীমের।

উল্টোরথের দুপুরে পোড়ামাতলায় দোকান সাজাতে সাজাতে অসীমের বাবা গোপালবাবু বলছেন, “লোকের পছন্দ বদলে গিয়েছে। চাহিদা কমছে মাটির পুতুলের। সস্তার চিনে পুতুল নিয়ে সবাই খুশি।” প্রায় ৩৬ বছর ধরে পুতুল গড়ছেন গোপালবাবু। তিনি জানান, শহরের মেলায় এখন আর পুতুলের তেমন বাজার নেই। তুলনায় গ্রামীণ মেলায় বিক্রি হয় ঢের বেশি। গোপালবাবুর কথায়, “সেই ছোট থেকে আমিও আমার ছেলের মতোই বাবার কাজের মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে কারিগর হয়ে উঠেছি। আমার নেশা বলতে এই পুতুল গড়া। ছেলেকেও সেই নেশা ধরেছে। তবে ওকে আর এ কাজ করতে দেব না।” ছোট্ট অসীম গোঁ ধরে আছে, “পরের বার আমি নিজেই পুতুল তৈরি করে রং করব। দেখি ওরা কী করে মুখ ফেরায়!”

বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি

অগ্রদ্বীপ ষ্টেশনে শঙ্কর বাঁশিওয়ালার বাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। বাঁশিওয়ালা বাড়ি আছেন? জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। বাড়ি থেকে ভেসে আসা মন ভাল করা সুরই জানান দেয় বাঁশিওয়ালার উপস্থিতি। নিজের হাতে বাঁশি তৈরি করে মেলায় মেলায় তা ঘুরে বিক্রি করা শঙ্কর মালের পেশা। গোপীনাথের মেলা থেকে জয়দেবের মেলা, গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা থেকে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা কিংবা নবদ্বীপের রাস বা উল্টোরথের মেলায় বছরভর ঘুরে বেড়ান তিনি। তারপর বাঁশি ফুরিয়ে গেলেও কাজ থেমে থাকে না। এরপর খ্যাপা খুঁজে ফেরে বাঁশি তৈরির উপকরণ। সোমবার নবদ্বীপের উল্টোরথের মেলায় ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন শঙ্করবাবু। মধ্য পঞ্চাশের বাঁশুরিয়ার বাঁশির মিষ্টি সুরে মন্ত্রমুগ্ধ ভিড়। চেনা সুরের জমাট বুনন থেকে অবলীলায় তিনি চলে যান বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় রাগে। মহানাম মঠের সামনের রাস্তায় তাঁর বাঁশি বিকেলের ‘পূরবীতে’ আলপনা আঁকতে আঁকতে হঠাৎ থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জমাট ভিড়টাও বাঁশি কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই বাঁশি বিক্রি করেন শঙ্করবাবু। তিনি বলেন, “দাদার কাছে সুর ও বাঁশি তৈরি দুই শিখেছি। কিছু দিন ওস্তাদের কাছেও যাতায়াত করেছি। প্রথমে ইচ্ছে ছিল শিল্পী হব। যাত্রা, বাউল গানের সঙ্গে বাজিয়েছি। একক অনুষ্ঠান ও করেছি। তারপর কেমন করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাঁশির কারিগর হয়ে গেলাম।”


নবদ্বীপে উল্টোরথের মেলায় শঙ্কর মাল (বাঁ দিকে) ও মন্টু সাহা (ডান দিকে)।

আমরা উল্টোরথে যাব

তিন দিন ধরে ভেজানো ৫০ কেজি ময়দা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন ৬৫ বছরের মন্টু সাহা। উনুনে কুড়ি কিলোগ্রাম চিনির রস শেষ বারের মতো পরীক্ষা করে দেখছিলেন তাঁর সহকারী। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল সাড়ে চারটে। পথে তখনও রথ নামেনি। কিন্তু মন্টুবাবুর দোকানে জিলিপির লম্বা লাইন। অসুস্থতার কারণে মন্টুবাবু এখন উৎসব ছাড়া জিলিপি ভাজেন না। অথচ হাতের এমন গুণ, কড়াইয়ে জিলিপি ছাড়ার আগেই ভিড়টা ছেঁকে ধরে, “ও দাদা, আমাকে আগে ছেড়ে দিন।” ১৯৫৬ সালে পাবনা থেকে বাবার হাত ধরে নবদ্বীপে এসেছিলেন মন্টুবাবু। বয়স তখন বড়জোড় নয় কী দশ। নবদ্বীপের সেকালের বিখ্যাত মিষ্টান্ন শিল্পী কালী ময়রার দোকানে কাজ শুরু করেন। সেই মিষ্টির প্রতি টান আর তাঁকে পালাতে দেয়নি। মাঝে কিছুদিন তাঁতের কাজ করেছেন। “কিন্তু যার মন ডুবে রয়েছে রসে, তাঁর কি আর খটখটে তাঁতে মন বসে?” হাসতে হাসতে বলছেন মন্টুবাবু।

জিলিপির সুগন্ধে ম ম করছে মেলা চত্বর। লাইনটা আরও বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। পড়ন্ত বিকেলে হাজারও মানুষের ভিড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মন কেমন করা বাঁশির সুর। পথের উপর বিছানো রয়েছে প্লাস্টিক। তারই একপাশে সাজানো রয়েছে নানা রকমের মাটির পুতুল। সেখানে এক বুক অভিমান নিয়ে বসে রয়েছে অসীম। মেলা প্রাঙ্গনে ভিড়টা আরও পুরু হয়। ছোট্ট নাতনির হাত ধরে সেই ভিড়ের দিকে এগিয়ে যান এক বৃদ্ধা। উল্টো দিক থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসে রথের চাকা। নাতনির হাত ছেড়ে কাঁপা কাঁপা হাতদুটো কপালে উঠে যায়। টুকরো টুকরো এমন অসংখ্য দৃশ্যে আরও রঙিন হয়ে ওঠে উল্টোরথ, মেলা প্রাঙ্গণ, উৎসবের মেজাজ।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debashish bandopadhyay nabadwip rath yatra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE