উপরে আনিসুর রহমান বিশ্বাস ও নীচে আব্দুল হক শেখ।
ফের অশান্ত হয়ে উঠল ফাজিলনগর।
শুক্রবার ভরদুপুরে জোড়া খুনের পরে এমন কথাই ভেসে বেড়াচ্ছে ফাজিলনগরের আনাচকানাচে। এদিন দুপুরে থানারপাড়ার নারায়ণপুর মাঠ এলাকায় খুন হন তৃণমূল নেতা আনিসুর রহমান বিশ্বাস (৬০)। ওই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই নারায়ণপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ঢুকে খুন করা হয় ওই পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য আব্দুল হক শেখকে (৬৫)। ঘটনার পরেই শুরু হয় রাজনৈতিক চাপানউতোর। তৃণমূল ও সিপিএম পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে। গ্রামে ছুটে আসে পুলিশ। জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, “প্রথমে একজন তৃণমূলের নেতা খুন হন। পরে খুন হন এক সিপিএমের পঞ্চায়েত সদস্য। খুনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রামে চলছে পুলিশি টহল।”
ফের কত বছর পর এমন খুন, রক্ত দেখল ফাজিলনগর তা মনে করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছিল গ্রামের অনেককেই। পাশাপাশি পুরনো সেই আতঙ্কও যেন গ্রাস করে ফেলেছে গোটা গ্রামকে। একটার পর একটা পুলিশের গাড়ি, সশস্ত্র পুলিশের টহল, গ্রামবাসীদের উদ্বিগ্ন মুখএসবই মনে করিয়ে দিচ্ছিল বছর দশেক আগের ফাজিলনগরকে। যখন গ্রাম শাসন করত ভারি বুটের শব্দ। দিনরাত। মাঝে অবশ্য শান্তি ফিরেছিল গ্রামে। তারপর ফের এই জোড়া খুন বদলে দিয়েছে গ্রামের চেনা চেহারা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ার যে ক’টি গ্রামে ঘাঁটি গেড়েছিল মাওবাদীরা, জলঙ্গি ঘেঁষা করিমপুর ২ ব্লকের ফাজিলনগর তাদের অন্যতম। জলঙ্গির চরের দখল নিয়ে নিত্য অশান্তি মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রশাসনের। মাওবাদীরাও তাদের অস্তিত্ব জানান দিত প্রতি মুহূর্তে। জেলা পুলিশের দাবি, মাওবাদীদের শীর্ষ নেতারাও একসময় ঘুরে গিয়েছেন এই গ্রাম। আর এরই মধ্যে ২০০৫ সালে ফাজিলনগরের লতিব মণ্ডলকে বাড়িতে ঢুকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। সেই খুনের ঘটনায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন লতিবের ভাই গনি মণ্ডল। দুষ্কৃতীরা সেইসময় তাঁকেও খুন করার হুমকি দেয়। এরপর সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়। ২০০৬ সালের ৬ নভেম্বর জলঙ্গি নদীর চরে তাঁদের নিজেদের জমিতে কাজ করছিলেন গনির ছেলে লেনিন মণ্ডল ও গনির দুই খুড়তুতো ভাই। বেলা দশটা নাগাদ গনি তাঁদের জলখাবার দিতে গেলে সেখানেই তাঁকে ঘিরে ধরে দুষ্কৃতীরা। ২০ থেকে ২৫ রাউন্ড গুলি চালানোর পর হামলাকারীরা ‘মাওবাদী স্লোগান’ দিতে দিতে আমতলা ঘাটের দিকে চলে গিয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল। এই দুই খুনের ঘটনায় যাঁরা অন্যতম অভিযুক্ত ছিল তারা অনেকেই পুলিশের খাতায় মাওবাদী বলে পরিচিত। এবং ওই দুই খুনের ঘটনায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন আনিসুর। তখন অবশ্য আনিসুর কংগ্রেস করতেন। পরে তিনি দলবদল করেন। বর্তমানে ওই এলাকায় তৃণমূলের দাপুটে নেতা বলেই পরিচিত ছিলেন আনিসুর। আর গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের আব্দুল হক শেখ সিপিএমের ফাজিলনগর শাখার সম্পাদক।
শোকার্ত পরিবার।
কিন্তু এই দুই খুনের মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র রয়েছে? পুলিশ জানিয়েছে, ফাজিলনগরের লতিব ও গনি খুনের ঘটনায় ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে আনিসুর-সহ সাত জনকে খুন ও খুনের ষড়যন্ত্রের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন তেহট্ট ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের বিচারক। তারপর মাসকয়েক আগে তিনি অবশ্য কলকাতা হাই কোর্ট থেকে জামিন পান। তারপর তিনি সংগঠন বাড়ানোর কাজেই মন দিয়েছিলেন। জেলা পুলিশের একাংশের অনুমান, পুরনো খুনের ঘটনার বদলা নিতে এই খুন হতে পারে। তার উপরে রয়েছে নারায়নপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের অস্থিরতা। আর আব্দুল হক শেখ? জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই গ্রাম পঞ্চায়েত ঘিরে বেশ কিছুদিন থকেই একটা অস্থিরতা চলছিল। এদিন আনিসুর খুন হওয়ার পরেই সঙ্গে সঙ্গে বদলা নিতে আব্দুল হককে খুন করা হতে পারেও বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিনের ঘটনার পর আনিসুরের স্ত্রী সাহেবা বিবি বলেন, “আমার স্বামীকে খুন করেছে সিপিএম। এই গ্রামের সবাই আমার স্বামীকে পছন্দ করে। এটাই সিপিএমের রাগের কারণ।” অন্য দিকে আব্দুল হকের ছেলে হুমায়ুন শেখ বলেন, “বাবাকে কারা এবং কেন মেরেছে আমরা বুঝতে পারছি না। ঘটনার পর আমরা সবাই খুব আতঙ্কে আছি।” তবে সিপিএমের দাবি, পঞ্চায়েত দখলের উদ্দেশে তাঁদের ওই পঞ্চায়েত সদস্যকে পরিকল্পনা করেই খুন করেছে তৃণমূল। ওই দুই রাজনৈতিক দল তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও কল্লোল প্রামাণিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy