Advertisement
E-Paper

জন্মাষ্টমীর রাতে অভিষেক মহাপ্রভুরও

শ্রাবণ হয়ে বার বার ফিরে আসে সেই রাত। মহাকাব্যের এক নায়ক, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে যিনি দেবতা, তাঁর জন্মলগ্ন। এ এক এমন তিথি, যখন দেবতা প্রিয় হয়ে ওঠেন। দেবতা সুলভ গাম্ভীর্যে বা সম্ভ্রমের দূরত্ব থেকে রোজকার মতো পুজার্চনা নয়। এই রাতে স্নেহে আর সেবায়, প্রেম আর প্রীতিতে ভক্ত ছুঁতে চায় মহাকাব্যের এক মহানায়ককে। এ রাত জন্মাষ্টমীর রাত।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:৪৮
জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সেজে উঠেছে মায়াপুর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সেজে উঠেছে মায়াপুর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

শ্রাবণ হয়ে বার বার ফিরে আসে সেই রাত। মহাকাব্যের এক নায়ক, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে যিনি দেবতা, তাঁর জন্মলগ্ন। এ এক এমন তিথি, যখন দেবতা প্রিয় হয়ে ওঠেন। দেবতা সুলভ গাম্ভীর্যে বা সম্ভ্রমের দূরত্ব থেকে রোজকার মতো পুজার্চনা নয়। এই রাতে স্নেহে আর সেবায়, প্রেম আর প্রীতিতে ভক্ত ছুঁতে চায় মহাকাব্যের এক মহানায়ককে। এ রাত জন্মাষ্টমীর রাত।

ভক্তিমার্গের মানুষকে যুগ যুগ ধরে আকর্ষণ করে আসছেন শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম। তিনি মহাকাব্যের মহানায়ক। এ দেশের মানুষ অবতারবাদে বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাস থেকেই জন্মাষ্টমীর মতো তিথিতে উৎসবের এই আয়োজন। কিন্তু জন্মাষ্টমীর উৎসব তাঁর মহানায়কোচিত বিশাল ব্যাপ্তির উদ্যাপন নয়। শৌর্যবীর্যের গুণকীর্তন নয়। বাৎসল্য রসের অবিরল ধারায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ রাতে বাড়ির ছোট্ট শিশুটি হয়ে ভক্তদের ঘরে ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় মথুরা থেকে মায়াপুর, নন্দপুরী থেকে নবদ্বীপে যেন অকাল কোজাগরী।

শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা রাতে গঙ্গার পশ্চিম তীরের নবদ্বীপ কিংবা পূর্ব পাড়ের মায়াপুরের মানুষ দু’চোখের পাতা এক করেন না। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। সুন্দর আজ ঘরে আসবেন। তারই প্রস্তুতিতে রবিবার থেকে মন্দিরে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার পুনরাভিনয় অথবা জন্মকথা পাঠ। সে কীর্তনের ‘মহাজন পদে’ বা ‘আখরে’ ঝরে পড়ে পরমকে কাছে পাওয়ার আকুতি। মল্লার কিংবা জয়জয়ন্তীতে বাঁধা সে কীর্তনের সুর সারারাত ভেসে বেড়ায় বর্ষার ভরানদীর ঘাটে ঘাটে। সর্বজনকে আবিষ্ট করে। কস্তুরি চন্দন অগুরুর সঙ্গে মিশে যায় জুঁই বেলির সুবাস। সুর আর সুগন্ধে মাখামাখি শ্রাবণ সন্ধ্যা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে গভীর রাত্রির দিকে। ভক্তদের ভিড়ে ঢাকা পড়ে যায় মন্দিরের চাতাল। তারপর অনেক রাতে অষ্টমী তিথি যখন রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করে, তখনই মাহেন্দ্রক্ষণ। মহাভিষেক শুরু হয়ে যায় মন্দিরে মন্দিরে। মধ্যরাতের স্তব্ধতা ভেঙে বেজে ওঠে অগণিত শাঁখ। ‘ওই মহামানব আসে।’ মৃদঙ্গ মন্দিরা করতাল ঘণ্টাধ্বনিতে নাটমন্দির থেকে নদীর কিনার ছুঁয়ে গৃহস্থের ঠাকুরঘরে পৌঁছে যায় বার্তা। শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিলেন। দেড়শোরও বেশি মঠমন্দিরে সমবেত হাজার হাজার ভক্তের যাবতীয় উন্মাদনা কেন্দ্রীভূত হয় এক এবং অদ্বিতীয় শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে।

উপলক্ষ এক হলেও উদ্যাপনের ধরন কিন্তু বিভিন্ন মঠে বিভিন্ন রকম। উৎসব সর্বত্রই শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে এমনটা কিন্তু নয়। যেমন বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভুর বিগ্রহকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করে জন্মাষ্টমী উদযাপিত হয় নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে। তেমনই রাধারমণ বাগ সমাজবাড়িতে বিশুদ্ধ বৃন্দাবনী ঘরানায় পালন করা হয় এই তিথি। হরিসভা মন্দির, গোবিন্দবাড়ি, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ বা কেশবজী গৌড়ীয় মঠ নিজের মতো করে পালন করে এই উৎসব। আবার গঙ্গার পূর্ব পাড়ের ইস্কন মন্দিরে জন্মাষ্টমীর উদযাপন আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে নানা দেশের ভক্ত সমাগমে।

নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়িতে প্রাচীন প্রথা মেনে জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণের নয় মহাপ্রভু বিগ্রহের অভিষেক হয়। কথিত রয়েছে, মহাপ্রভুর জীবিত কালেই এই বিগ্রহ নির্মাণ করান বিষ্ণুপ্রিয়া স্বয়ং। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের এই মূর্তি নির্মাণ করান। সেই বিগ্রহের সেবাপুজো নিয়েই তিনি বাকি জীবন কাটান। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। বলা হয় যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। ইতিহাসের কথা থাক। বর্তমানে সারা বিশ্বের বৈষ্ণবভক্ত নবদ্বীপে ছুটে আসেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীসেবিত এই ধামেশ্বর মহাপ্রভুর টানে। মহাপ্রভু মন্দিরের তরফে লক্ষীনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “সুপ্রাচীন এই বিগ্রহের ওপর তো মহাভিষেক বা মহাস্নান করানো সম্ভব নয়। তাঁর বদলে জগন্নাথ মিশ্র সেবিত রাজরাজেশ্বর নারায়ণ শিলাকে শ্রীকৃষ্ণের প্রতিনিধি রূপে কল্পনা করে করে অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।” অভিষেকের সময় মহাপ্রভুকে পরানো হয় লাল চেলি। কেবল এই দিনের জন্য মহাপ্রভু হয়ে ওঠেন বংশীধারী।

সমাজবাড়িতে বৃন্দাবনের মতো করেই উৎসব পালিত হয়। এখানে শ্রীকৃষ্ণ যতটা ভগবান তার থেকে অনেক বেশি প্রিয় বালক। বাৎসল্য এবং মধুর রসে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন এই মন্দিরের সেবায়েতরা। এখানে উৎসবের দুটি অংশ। দু’দিন ধরে উৎসব পালিত হয়। প্রথম দিন ব্রত এবং দ্বিতীয় দিন নন্দোৎসব। নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম-সহ অন্য মন্দিরগুলিতে উৎসবের ধাঁচ অনেকটা একই রকম। মঠের প্রধান তথা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “যেখানে যে মতই অনুসরণ করা হোক না কেন, মঙ্গলারতি, শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাপাঠ, বিশেষ কীর্তন, অভিষেক, ভোগরাগ-- এই সব একই ভাবে উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সর্বত্র পালন করা হয়।”

ইস্কন মন্দিরেও একই রকম ভাবে পালিত হয় জন্মাষ্টমীর উৎসব। আগের দিন উৎসবের সূচনা হয় মহাস্নানের প্রস্তুতি পর্ব দিয়ে। কয়েক হাজার দেশি বিদেশি ভক্ত গঙ্গা থেকে আনেন মহাভিষেক বারি। জন্মাষ্টমীর ঠিক মুহূর্তে দুধ, ঘি, মধু, দই প্রভৃতির সঙ্গে এক হাজার কলস গঙ্গাজল দিয়ে সম্পন্ন হয় মহাভিষেক পর্ব। তবে জন্মাষ্টমীতে ইস্কনের অন্যতম আকর্ষণ ‘পুষ্পবৃষ্টি’। বৃষ্টিধারার মতো বিগ্রহের উপর ঝরে পড়তে থাকে গোলাপ-জুই-বেলি-কামিনী-চাঁপা ফুলের পাপড়ি। চার ফুটের বিগ্রহ ঢাকা পড়ে যায় ফুলে ফুলে। বলা হয়, এই উৎসবের নির্দেশিকা নাকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের তৈরি করা। কুরুক্ষেত্রের শেষে যুধিষ্ঠির সখা কৃষ্ণের জন্মদিন সাড়ম্বরে উদযাপনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ নাকি বলেছিলেন কেমন ভাবে তাঁর জন্ম উৎসব পালন করতে হবে। সেই প্রথা মেনেই নাকি জন্মাষ্টমী পালিত হয়ে আসছে।

janmasthami mahapravu nabadip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy