পূর্ণিমার রাতের সেই উত্সবের একটি মুহূর্ত।—নিজস্ব চিত্র।
আকাশ ভেঙে নামছে বৈশাখী পূর্ণিমার সাদা জ্যোত্স্না। নদীর বুকে ভাসছে এক আশ্চর্য জলযান। তার উপরে সুসজ্জিত রুপোর চতুর্দোলা। জুঁই, বেল, রজনীগন্ধার মালায় সাজানো সেই নৌকার সিংহাসনে প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। নৌকা চলছে নদীর পাড় ঘেঁষে। সেখানে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। অগুরু চন্দন আতরের গন্ধে ম ম করছে মধ্যরাতের নদীতীর। আর সেই জলযান থেকে ভেসে আসছে বসন্ত রাগে গাওয়া কীর্তনের সুর। গাওয়া হচ্ছে মহাজনী পদ-‘রাধিকা বেশে মনের হরষে কুসুম রচনা করে / মল্লিকা মালতি আদি জাতিযুথি সাজাইল থরে থরে / ফুলের চোয়ারি, ফুলের কেয়ারি ফুলেতে ছাইল ঘর/ ফুলের বালিশ, আলিস কারন প্রতি ফুলে ফুলশর।’
বৈষ্ণব শাস্ত্র মতে বসন্ত উত্সবের সূচনা হয় শ্রীপঞ্চমীতে আর সমাপ্তি বৈশাখী পূর্ণিমায়। বসন্তবিদায়ের এমন রাতেই রাধাকৃষ্ণের বৈশাখী রাস। এমন তিথি বৈষ্ণবদের কাছে দুর্লভ। নবদ্বীপের হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারি বলেন, “১৪৮ বছর এদিনেই নবদ্বীপে প্রথম চৈতন্যদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রকাশ্যে পুজো শুরু হয়েছিল। সেকালের রাজপণ্ডিত তথা প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রজনাথ বিদ্যারত্নই প্রথম মানুষ যিনি তত্কালীন যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নবদ্বীপে চৈতন্যভজনা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করা হয় হরিসভা। তা ছাড়া এই তিথিতেই গৌরাঙ্গদেব এবং বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর বিবাহ হয়েছিল। সর্বোপরি এ দিন চন্দন যাত্রা এবং ফুল দোল।”
সমস্ত বৈষ্ণব মঠমন্দিরে তাই চন্দনযাত্রার ব্যস্ততা। চন্দনযাত্রার হাত ধরে সারা দেশের বৈষ্ণব সমাজ এদিন স্মরণ করেন মাধবেন্দ্র পুরীকে। তাঁরই প্রবর্তিত এই চন্দনযাত্রা এক আশ্চর্য উত্সব, যেখানে কোনও মন্ত্র নেই, নেই পুজোপাঠের কোনও চেনা প্রকরণ। চন্দনযাত্রা সুর আর সুগন্ধে ভরা এমন এক উত্সব, যা প্রখর গ্রীষ্মে ভক্ত এবং ভগবান উভয়েরই শরীর মন শীতল করে। ভেষজশাস্ত্র এবং সঙ্গীতশাস্ত্রের অননুকরনীয় মেল বন্ধন ঘটেছে এই উত্সবে। দেহ শীতল রাখতে চন্দনের ব্যবহার বহুকালের, বৈষ্ণবেরাও গরমের সন্ধ্যায় বিগ্রহের অঙ্গে পুরু করে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে নৌকা করে নদীতে জলবিহারে যান। গভীর রাত পর্যন্ত নৌকা ভ্রমণ চলে। আর এই পুরো পর্ব জুড়ে থাকে কীর্তন।
চন্দনযাত্রা প্রসঙ্গে এসময়ের নামী কীর্তনীয়া সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “দক্ষিণভারতে প্রায় সমস্ত মন্দিরে দেবতার গায়ে গরমের সময় চন্দন বেটে প্রলেপ দেওয়া হয়। আমাদের কাছে দক্ষিণের সূচনা হয় পুরী থেকে। পুরীর জগন্নাথ দেবের চন্দনযাত্রা বিখ্যাত।” মাধবেন্দ্র পুরী শুরু করলেও চন্দনযাত্রাকে পুনরুজ্জীবিত করেন চৈতন্যদেব। তাঁর হাতেই বৃন্দাবন এবং পুরীতে এই উত্সব নতুন করে প্রাণ পায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সভাপতি অদ্বৈত দাস বলেন, “পুরী বা বৃন্দাবনে চন্দনযাত্রার সূচনা হয় অক্ষয় তৃতীয়া থেকে। বৈশাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় জগন্নাথ-সহ বিভিন্ন বিগ্রহের গায়ে চন্দন মাখানো হয়। বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের জলবিহার হয় যমুনায়। নবদ্বীপে উত্সব চলে তিন দিন।”
এই তিন দিন সন্ধ্যা নামতেই নবদ্বীপের সমাজবাড়ির শতাব্দী প্রাচীন রাধারমণ বিগ্রহ প্রায় তিন কুইন্টাল ওজনের প্রকান্ড রূপোর সিংহাসনে নগর পরিক্রমায় বের হন। ফুলে ফুলে সাজানো শোভাযাত্রা গ্যাসের আলো, গোলাপ জল, আতর আর হারিয়ে যেতে বসা কীর্তনের সুরে নবদ্বীপকে যেন সেই শতাব্দী প্রাচীন সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। রাত বাড়লে শোভাযাত্রা চলে যায় গঙ্গার ঘাটে। সেখানে সুসজ্জিত নৌকার উপরে সারা রাত চলে কীর্তন। সমাজবাড়ির জনক দাস বাবাজি বলেন, “ওই তিনদিনের উত্সবের তিনটি ভিন্ন নাম আছে। প্রথম দিন যমুনা উত্সব। দ্বিতীয় দিন মানসগঙ্গা উত্সব আর শেষ দিনে বৈশাখী রাস। প্রতিদিন বিশেষ ধরনের কীর্তন সহযোগে উত্সব পালিত হয়। থাকে রকমারি ভোগের ব্যবস্থাও। তবে কোনও মন্ত্র বা পুজোপাঠের ব্যবস্থা থাকে না। নানা সুরের কীর্তনই এই উত্সবের প্রধান মন্ত্র।” সেবাইতরা সকলে নারী বেশে এই উত্সবে অংশ নেন। বিগ্রহ সহ সকলের পোশাকের রঙ থাকে সাদা।
চন্দনযাত্রার আর একনাম ফুল দোল। নবদ্বীপের প্রায় সমস্ত মন্দিরে এদিন ফুলদোল পালিত হয়। কীর্তনের খোঁজে চন্দনযাত্রায় এসেছিলেন লোকসঙ্গীতের পরিচিত মুখ কালিকাপ্রসাদ। তিনি বলেন, “কীর্তনকে বাংলার আদি গান বলেছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ। চন্ডীদাস থেকে শুরু করে এই একুশ শতক পর্যন্ত বাংলা কীর্তনের যে বিশাল ধারা বয়ে চলেছে, তাঁর অন্যতম উত্স নবদ্বীপ। এই কীর্তনের প্রভাব রয়েছে বাংলার নানা বর্গের লোকায়ত সঙ্গীতে। চন্দনযাত্রার মত উত্সবে বিশেষ কীর্তন আর হয়তো খুব বেশি দিন শোনা যাবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy