Advertisement
০৫ মে ২০২৪

তেত্রিশ বছর কেটে গেল, তবু পানীয় জলের সমস্যা মিটল না বেলডাঙায়

১৯৮১ সালে ১৭টি ওয়ার্ড নিয়ে বেলডাঙাকে পুরসভার মর্যাদা দেয় তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। তারপরে কখনও বামফ্রন্ট, কখনও কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরসভা। কিন্তু তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও বেলডাঙায় জলকষ্টের কোনও সুরাহা হয়নি। বেলডাঙায় পানীয় জলের এই সমস্যা বহু পুরনো। বেলডাঙা তখনও পুরসভা হয়নি। এলাকার বাসিন্দাদের পানীয় জলের ভরসা ছিল নলকূপ।

পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই চলে যায় জল সংগ্রহ করতে। —নিজস্ব চিত্র

পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই চলে যায় জল সংগ্রহ করতে। —নিজস্ব চিত্র

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪৫
Share: Save:

১৯৮১ সালে ১৭টি ওয়ার্ড নিয়ে বেলডাঙাকে পুরসভার মর্যাদা দেয় তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। তারপরে কখনও বামফ্রন্ট, কখনও কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরসভা। কিন্তু তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও বেলডাঙায় জলকষ্টের কোনও সুরাহা হয়নি।

বেলডাঙায় পানীয় জলের এই সমস্যা বহু পুরনো। বেলডাঙা তখনও পুরসভা হয়নি। এলাকার বাসিন্দাদের পানীয় জলের ভরসা ছিল নলকূপ। কিন্তু সেই জলে অত্যন্ত আয়রন থাকত। জলের সমস্যা দূর করতে ১৯৭৭ সালে বেলডাঙা থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে তকিপুরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে তৈরি হয় ভূগর্ভস্থ জল প্রকল্প। সেই জল পরিস্রুত করে পাইপের মাধ্যমে বেলডাঙায় পাঠানোর কাজ শুরু হয়। সেই বছরেই তকিপুর থেকে আসা ওই জল ধরে রাখতে বেলডাঙায় নির্মাণ করা হয় ৫,৬৮,০০০ লিটারের বড় জলাধার। ঠিক তার তার চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৮১ সালে বেলডাঙা পুরসভার মর্যাদা পায়।

তারপরে জলের সমস্যা কিছুটা মিটলেও দেখা দেয় আর এক সমস্যা। পুরসভা ঘোষণা হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর পরেই বেলডাঙা ১ ব্লককে সরকারি ভাবে আর্সেনিক কবলিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া তকিপুর থেকে বেলডাঙা পর্যন্ত আসা জলের পাইপ ফাটিয়ে জল নেওয়ার অভিযোগ ওঠে চাষিদের একাংশের বিরুদ্ধে। গ্রীষ্মে প্রচণ্ড জলকষ্ট শুরু হয়। বর্ষার সময় সেই পাইপের মধ্যে ঢুকে যেত নয়ানজুলির জল। বেলডাঙার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিকাশ মণ্ডলের এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই সময়ের কথা। বিকাশবাবু বলছেন, “সে এক বিড়ম্বনা। আমরা জানি তকিপুর থেকে পরিস্রুত জল আসছে। কিন্তু পাড়ার টাইম-কলে যে জল আসত তাতে পচা পাটের গন্ধ পাওয়া যেত। আসলে নয়ানজুলিতে চাষিরা পাট পচাতেন। আর সেই জল ফাটা পাইপের মধ্যে ঢুকে যেত। সে জল মুখে তোলা যেত না।”

এরপর শহরের বাসিন্দারা দাবি করে ভূ-তল জল প্রকল্পের। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে বেলডাঙার মহ্যমপুরে ভূ-তল জল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টার্চায। এই প্রকল্পে শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ভাগীরথীর জল পরিস্রুত করে পাইপের মাধ্যমে জল সরবরাহ শুরু হয়। প্রথমে সেই জল সরবরাহ শুরু হয় আর্সেনিক কবলিত কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ও শহরে।

২০১০ সালে পুরভোটে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। নতুন পুরবোর্ড প্রথম দিকে পানীয় জল নিয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেও জল-সমস্যা আজও বেলডাঙার নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে পুরসভার ১৪ টি ওয়ার্ডের মধ্যে অধিকাংশ ওর্য়াডেই জলের সমস্যা রয়েছে। তবে সব থেকে সমস্যা বেশি ৯, ১০, ১৩, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে। ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পাইপ লাইনে জল পৌঁছয় না। সেখানে পুরসভার জলের ট্যাঙ্কে করে জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বেলডাঙার এই জল সঙ্কট নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোরও কম হয়নি। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই সমস্যাকে হাতিয়ার কংগ্রেস ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই প্রচার করে। লোকসভা ভোটের আগে ১০ মে বেলডাঙায় প্রচারে এসেছিলেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলারা তাঁকে পানীয় জলের সমস্যার কথা জানান। ভোট মিটলে অধীরবাবুর নির্দেশে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে গাড়িতে করে জল সরবরাহ করা হয়।

২০১৫ সালে বেলডাঙায় পুরভোট। এর মধ্যে অগস্টের প্রথমে পুরসভার চার জন কংগ্রেস কাউন্সিলার তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেস বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এই অবস্থায় পুরসভার পানীয় জলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলার ভরত ঝাওর। তিনি বলেন, “জল যেখান থেকে আসে সেখানে বিদ্যুতের সমসা থাকায় একটা সমস্যা হয়েছিল। সেই সমস্যা এখন মিটে গিয়েছে। ফলে এ বার পুজোর মুখে জল সরবরাহে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া বিষয়টি জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরেরও দেখা উচিত। কিন্তু সবসময় তাদের সহযোগিতাও পাওয়া যায় না।” তিনি জানান, সচেতনতার অভাবে কিছু এলাকায় কল সবসসময় খোলা থাকে। জলের অপচয় হয়। অনেকে মেশিনের মাধ্যমে জল তুলে নেন। এতে অন্যান্যদের অসুবিধা হয়। এই বিষয়গুলোতেও শহরের মানুষদের কাছ থেকে আমরাও সহযোগিতা চাইছি। যদিও জেলার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সরবরাহ) জয়দেব সরকার বলেন, “বেলডাঙায় জল সরবরাহের এই ব্যবস্থা অনেক পুরনো। আর আমাদের না জানিয়ে, পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি না করে পুরসভা জলের কলের সংখ্যা আগের থেকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতেই এই বিপত্তি। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরাও ভাবছি।”

শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অনামিকা মণ্ডল বলছেন, “আমরা সবরকম ভাবে সহযোগিতা করতে রাজি। কিন্তু পুরসভা তো ন্যূনতম পরিষেবাটুকু দেবে। ভোটের আগে পানীয় জল নিয়ে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেয় সব দল। কিন্তু ভোট মিটতেই আর কেউ কিছু করে না।” ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শঙ্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “জলের এই সমস্যা কবে মিটবে কে জানে!” ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আফজল শেখ বলেন, “নিচু জায়গায় জল পাওয়া যায়। কিন্তু উঁচু জায়গা হলেই কলে জল পড়ে না।”

কেন জল সমস্যা আজও মিটল না? পুরপ্রধান কংগ্রেসের অনুপমা সরকার বলেন, “পানীয় জল নিয়ে শহরের মানুষের যাতে কোনওরকম অসুবিধা না হয় সে জন্য আমরা সবরকম চেষ্টা করছি। কিন্তু সব কিছুই তো আর আমাদের হাতে নেই। শহরে জল সরবরাহের জন্য ১৯৭৭ সালে তৈরি লোহার পাইপ বহু জায়গায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে সেদিক দিয়ে জল আসার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়। পাইপ পাল্টে নতুন পাইপ বসানোর একটা মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করলে এই সমস্যা আর থাকবে না।” তার জন্য বেলডাঙাকে আরও কত বছর অপেক্ষা হবে? উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

beldanga water crisis sebabrata mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE