Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
অভিযুক্ত তৃণমূলের উপপ্রধানও

থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরে রাতভর জুয়ার আসর

সূর্য উঠেছে সবে। ঘড়ির কাঁটায় ৬টা। একহারা চেহারার বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক শ’পাঁচেক বর্গফুটের পাকা ঘরের তিনটি কালো শাটার খুললেন। তারপর ঘরের এ-মুড়ো ও-মুড়ো যত্ন করে ঝাঁট দিয়ে ধুপ-ধুনো জ্বালালেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আশপাশের লোকজনে ভরে গেল ঘর। খেজুরের পাতার বিছানায় বসে শুরু হয়ে গেল জুয়া। পাশেই পাতা রয়েছে দু’টি বেঞ্চি। সেখানে সতর্ক দৃষ্টিতে বসে রয়েছে মালিকপক্ষ। খেলোয়াড়রা হারুক বা জিতুক পোয়াবারো মালিকপক্ষের। এক হাজার টাকার খেলা হলে মালিকপক্ষের পকেটে ঢোকে অন্তত পঞ্চাশ টাকা।

মনিরুল শেখ
নাকাশিপাড়া শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০২:১০
Share: Save:

সূর্য উঠেছে সবে। ঘড়ির কাঁটায় ৬টা। একহারা চেহারার বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক শ’পাঁচেক বর্গফুটের পাকা ঘরের তিনটি কালো শাটার খুললেন। তারপর ঘরের এ-মুড়ো ও-মুড়ো যত্ন করে ঝাঁট দিয়ে ধুপ-ধুনো জ্বালালেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আশপাশের লোকজনে ভরে গেল ঘর। খেজুরের পাতার বিছানায় বসে শুরু হয়ে গেল জুয়া। পাশেই পাতা রয়েছে দু’টি বেঞ্চি। সেখানে সতর্ক দৃষ্টিতে বসে রয়েছে মালিকপক্ষ। খেলোয়াড়রা হারুক বা জিতুক পোয়াবারো মালিকপক্ষের। এক হাজার টাকার খেলা হলে মালিকপক্ষের পকেটে ঢোকে অন্তত পঞ্চাশ টাকা। এ ভাবে খেলা চলে ভোর অবধি। আগন্তুকদের গলা ভেজাতে চায়ের বন্দোবস্ত রয়েছে। এমনকী দূর থেকে যারা আসে, তাদের জন্য পেল্লাই সাইজের স্টোভে ভাত-ডালও রান্না হয়।

গণ্ডগ্রামের কলাবাগান বা বাঁশবাগান নয়। নদিয়ার নাকাশিপাড়া থানা থেকে মেরেকেটে দেড়শো মিটার দূরে ভরা বাজারে সূর্য পাটে যেতেই বসে জুয়ার আসর। নাকাশিপাড়ার বিভিন্ন গ্রাম এমনকী দেবগ্রাম, পলাশী, কালীগঞ্জ থেকেও লোকজন ভিড় জমায় সেখানে। জুয়াড়িদের চিকার-চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। শিবানী সিনেমা হলের গলিতে ওই জুয়ার আসরের বাড়িটি আবার নাকাশিপাড়া-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের মনোরঞ্জন মালাকারের। মনোরঞ্জন ওরফে মনা মাছের আড়তদার। অভিযোগ, মনা ছাড়াও ওই ঠেকের সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে সঞ্জু সাহা, সমীর সাহা ও খগেন সাহার। এদের কারও বা মাছের আবার কারও বা গাড়ির কারবার। মনোরঞ্জনবাবু অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। চার বছর ধরে ওই ঘর বন্ধ রয়েছে।” সোমবার সন্ধ্যায় প্রতিবেদকের সামনেই ঘর খুলেছে শুনে চুপ করে যান মনোরঞ্জনবাবু।

মাস দু’য়েক আগে বেথুয়াডহরি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের খিদিরপুর মধ্যপাড়ার জনা তিরিশেক বাসিন্দা অবশ্য ওই ঠেকের বিরুদ্ধে নদিয়ার জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও স্থানীয় বিডিও-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন যখন, স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন, ‘স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশে মনা ও তার দলবল জুয়ার ঠেক চালিয়ে পরিবেশকে কালিমালিপ্ত করছে।’ নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, ‘‘অভিযোগ পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” আর নাকাশিপাড়ার বিডিও হেমন্ত ঘোষ অভিযোগ পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, “যেখানে পুলিশই অভিযুক্ত, সেখানে আমি কী করব?”

বিডিও-র মতোই পুলিশি ভূমিকায় হতাশ নাকাশিপাড়ার সাধারণ মানুষ। মাস ছ’য়েক ধরেই নাকাশিপাড়া থানা এলাকার অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো অনিয়ন্ত্রিতভাবে গজিয়ে উঠেছে জুয়ার বোর্ড। সিনেমা হলের গলি ছাড়াও ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বের সুপার মার্কেটেও বসে জুয়ার আসর। খিদিরপুর মধ্যপাড়ার আমবাগান, কাঁঠালবেড়িয়ার শিমুলতলা, ধর্মদা বাজারের অনতিদূরে গুড়গুড়ি খালের ধারেও সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে জুয়াড়িদের আড্ডা। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাতভর জুয়ার ঠেকের চিৎকার ও অনর্গল গালাগাল পরিবেশকে কলুষিত করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে যুবসমাজের। কারণ এই সব ঠেকে দুষ্কৃতীরা ছাড়াও এখন স্কুল-কলেজের পড়ুয়া, বেকার যুবকরা ভিড় করছে নিয়মিত। ধর্মদা এলাকার এক ব্যক্তি জানালেন, তাঁর স্কুল পড়ুয়া ছেলে নিয়ম করে জুয়ার ঠেকে গিয়ে পয়সা উড়িয়ে আসে। ফলে তাঁর সচ্ছল সংসারে আজ টানাটানি শুরু হয়েছে।

জুয়ার নেশায় সর্বস্বান্ত করার নানা ফিকির রয়েছে ঠেকে। বেকার যুবকরা খেলায় হেরে গেলে নিজের মোটর-বাইক বন্ধক দিয়ে টাকা উসুলের বৃথা আশায় পুনরায় খেলছে। ঠেকেই হাজির থাকে সোনার গয়না বা মোটর বাইক বন্ধক নেওয়ার লোক। এক রাতে দশ শতাংশ হারে সুদে জিনিসপত্র বন্ধক দিতে বাধ্য হয় হেরো-পক্ষ। নাকাশিপাড়ার এক রিকশাওয়ালা বললেন, ‘মাস খানেক আগে নেশার টানে জুয়ার ঠেকে গিয়েছিলাম। হাজার খানেক টাকা হারার পর বাধ্য হয়ে বিয়ের আর্শীবাদের আংটিটাই বন্ধক দিলাম। চড়া সুদ মিটিয়ে আজও সে আংটি ছাড়াতে পারলাম না। এই নিয়ে বাড়িতে নিত্য অশান্তি হয়।” বাজারের এক ছোট সব্জি দোকানের মালিক জানালেন, জুয়ার নেশায় তাঁরও কষ্ট করে কেনা মোটর বাইক ও স্ত্রী-র গয়না বন্ধকে পড়ে গিয়েছে। মাস দেড়েক হয়ে গেলেও ছাড়াতে পারেননি। সমাজবিরোধীরা আবার জুয়ায় হেরে গিয়ে বেড়িয়ে পড়ে এলাকায় চুরি-ডাকাতি করতে। নাকাশিপাড়ায় সম্প্রতি এই কারণে চুরি-ডাকাতিও বেড়ে গিয়েছে।

যার যাচ্ছে, সে প্রতিবাদ করছে। সংসারের বিপদ বুঝে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন মহিলারাও। কিন্তু বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদে রাশ টানা যাচ্ছে না জুয়া খেলায়। গর্জে উঠতে হবে এক সুরে। চাপা ক্ষোভের আগুনে চলছে তারই প্রস্তুতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE