এক জন চাইছেন স্বামীর প্রকৃত হত্যাকারী শাস্তি পাক। আর একজন চাইছেন স্বামী নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে সসম্মানে মুক্তি পান। তৃণমূল ছাত্রনেতা সজল ঘোষ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগের রাতটা জেগেই কাটাল বাদীপক্ষ পূর্বস্থলীর ‘চুপি’ আর বিবাদীপক্ষ নবদ্বীপের ‘তুড়োপাড়া’।
২০১২’র ৯ জানুয়ারি রাতে নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে গুলি করে খুন করা হয়েছিল সজল ঘোষকে। ওই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত পূর্বস্থলীর কুলকামিনী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রদীপ সাহা। ঘটনার রাতে প্রদীপবাবুকে পুলিশ গ্রেফতার করে। নিম্ন আদালত বা হাইকোর্ট কোথাও জামিন না পাওয়ায় তিনি সেই রাত থেকেই জেল বন্দি। প্রায় দু’বছর আগের ওই হত্যাকাণ্ড কী খুনের মিথ্যা মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেওয়া, নাকি সত্যিই পথের কাঁটা সরাতে রাজনৈতিক শত্রুকে খুনের চেনা ছকদু’বছর ধরে এই প্রশ্নে তোলপাড় হয়েছে আদালত থেকে ভোটের ময়দান। সাক্ষীসাবুদ, জেরা, জবানবন্দি শেষে বুধবার মিলবে এই প্রশ্নের উত্তর। আজ দুপুরে নবদ্বীপের অতিরিক্ত জেলা এবং সেশন জজ সুধীর কুমারের আদালতে বিচারাধীন সজল ঘোষ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৯ জানুয়ারি দুপুরে। ওই দিন পূর্বস্থলী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়াকে ঘিরে কলেজ চত্বরে এসএফআই-এর সমর্থকেরা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়ে পড়েন। কলেজের দু’জন টিএমসিপি সমর্থক এবং একজন এসএফআই সমর্থক আহত হয়ে নবদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই রাতে পূর্বস্থলী উত্তরের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতাকর্মী নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। আহতদের দেখে নীচে নেমে আসার পর নবদ্বীপ হাসপাতাল চত্বরে তৃণমূলের পূর্বস্থলী অঞ্চল সহ-সভাপতি সজল ঘোষ খুন হন। মামলার এক নম্বর সাক্ষী পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়ের এফআইআর অনুযায়ী, সেই রাতে প্রদীপ সাহা মোটর বাইকে করে লোকনাথ দেবনাথ এবং লাল হেলমেট মাথায় এক জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে নিয়ে নবদ্বীপ হাসপাতালে আসেন। অভিযোগ খুনের সময় প্রদীপবাবু সজল ঘোষকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেন এবং লোকনাথ তাঁর চাদরের ভিতর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে সজল ঘোষকে গুলি করেন। এরপর তিন জন বাইকে উঠে হাসপাতাল চত্বর থেকে বেরিয়ে যান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিরা আহত সজলবাবুকে তুলে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
মামলার মোট ছ’জন অভিযুক্তের মধ্যে প্রধান লোকনাথ দেবনাথকে পুলিশ আজও ধরতে পারেনি। বাকি চার জন জামিনে মুক্ত। যদিও সরকার পক্ষের আইনজীবীর তরফে আদালতে জানানো হয়েছে প্রদীপ সাহা ছাড়া বাকি ধৃতদের বিরুদ্ধে তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই। ফলে যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রে এখন প্রদীপ সাহা।
২০১৩ সালের অগস্ট মাসে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে নবদ্বীপের অতিরিক্ত জেলা এবং সেশন জজের আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়। মোট উনিশ জন এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ১৯ নভেম্বর মামলার শুনানি শেষ হয়। তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় বুধবার ঘোষণা হচ্ছে বহুচর্চিত সজল ঘোষ হত্যা মামলার রায়।
মামলার অন্যতম অভিযুক্ত প্রদীপ সাহার স্ত্রী শম্পা মৈত্রের প্রত্যাশা তাঁর স্বামীকে আদালত সসম্মানে মুক্তি দেবে। নদিয়ার পানশিলা গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা শম্পা দেবী বলেন, “একটা ঘুমন্ত মানুষকে যে ভাবে মাঝরাতে বাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে খুনের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে তা তুলনাহীন। কোনও কাগজপত্র ছাড়াই গ্রেফতারের সময় পুলিশ বলেছিল ওঁর নিরাপত্তার জন্যই নাকি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর প্রায় তিন বছর হতে চলল। উনি এখনও ছাড়া পাননি। তবে আমি আশাবাদী আদালত ওঁকে মুক্তি দেবে।” প্রদীপবাবুর বৃদ্ধা মা দীপালি সাহা, বাবা মনীন্দ্র সাহার কথায়, “এমন শিক্ষা ছেলেকে আমরা দিইনি। আমাদের স্থির বিশ্বাস আদালত ওকে সসম্মানে মুক্তি দেবে।” অন্য দিকে, পূর্বস্থলীর চুপিতে নিজের বাড়িতে বসে সজল ঘোষের স্ত্রী ইন্দ্রাণীদেবী বলেন, “আমার একমাত্র ছেলে, বাবা কাকে বলে জানতেই পারল না। তিন বছর বয়সে ও বাবা হারিয়েছে। এর জন্য যে দায়ী আমি তার শাস্তি চাই। আর কিছু না। আদালতের সামনে সব পক্ষই তাঁদের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন। আমি আশাবাদী ন্যায় বিচার পাব।”
পূর্বস্থলীর বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মামলার তদন্তে খুশি নন। তিনি বলেন, “তদন্তে অনেক গোলমাল আছে। তবে আমার বিশ্বাস প্রদীপ সাহার শাস্তি হবেই।” মামলার অন্যতম সাক্ষী পঙ্কজ গঙ্গোপাধায় বলেন, “চোখের সামনে ওই রাতে যা যা ঘটেছে, আদালতে জানিয়েছি। আশা করি সুবিচার পাব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy