Advertisement
E-Paper

নদিয়ারাজের ঐতিহ্য মেনে পুজো বেলপুকুরে

বিল্বপুষ্করিনী। ডাক নামে বেলপুকুর। সারা বিশ্বের বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে এই গ্রামটি চৈতন্যদেবের মামার বাড়ি বলেই পরিচিত। চৈতন্যর মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর বাস ছিল এই গ্রামে। ভক্তজনের বিশ্বাস, এখনও এই গ্রামে যে মদনগোপালের দারুমূর্তির নিত্যসেবা হয়, তা নীলাম্বরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বেলপুকুরকে নবদ্বীপের ন’টি দ্বীপের শেষ বা সীমান্ত দ্বীপ মনে করে দোলের সময় নবদ্বীপ মহামণ্ডল পরিক্রমায় আসেন ভক্তেরা।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনিরুল শেখ

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২২

বিল্বপুষ্করিনী। ডাক নামে বেলপুকুর। সারা বিশ্বের বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে এই গ্রামটি চৈতন্যদেবের মামার বাড়ি বলেই পরিচিত। চৈতন্যর মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর বাস ছিল এই গ্রামে। ভক্তজনের বিশ্বাস, এখনও এই গ্রামে যে মদনগোপালের দারুমূর্তির নিত্যসেবা হয়, তা নীলাম্বরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই বেলপুকুরকে নবদ্বীপের ন’টি দ্বীপের শেষ বা সীমান্ত দ্বীপ মনে করে দোলের সময় নবদ্বীপ মহামণ্ডল পরিক্রমায় আসেন ভক্তেরা। এহেন বেলপুকুরে শ্যামাপুজোর রাতে তিনশোরও বেশি কালীপুজো হয়। বিশুদ্ধ তন্ত্র মতে ষোড়শোপচারে মাতৃসাধনা বেলপুকুরের কয়েকশো বছরের ট্র্যাডিশন।

কিন্তু স্বয়ং চৈতন্যের প্রভাব সত্ত্বেও বেলপুকুরে কালীপুজোর এমন প্রভাব কেন? স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির গবেষণার সূত্র থেকে জানা যায় যে, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপিতামহ রুদ্র রায়ের আমলে রামচন্দ্র ভট্টাচার্য নামে এক শক্তিসাধক ঢাকার কণকসার গ্রাম থেকে এখানে বসবাসের জন্য আসেন। তিনি রাজানুগ্রহে ৯০০ একর নিষ্কর জমিও পান। তবে রাজার শর্ত ছিল একটিই। এখানে যাঁরাই বসবাস করবেন তাঁদেরই শক্তি সাধনা করতে হবে। সেই থেকেই বেলপুকুরে কালীপুজোর সূচনা। সেকালে কালীপুজো করলেই মিলত রাজানুগ্রহ। আজ সেই রাজাও নেই, রাজানুগ্রহও নেই। কিন্তু পুজোর সেই ধারা রয়ে গিয়েছে।

বেলপুকুর এক আশ্চর্য গ্রাম। ধনী-দরিদ্র সবাই এখানে মাতৃসাধক। সেই রামচন্দ্রের পরিবার পরবর্তী কালে বাড়তে বাড়তে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্রামের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশই সেই শক্তিসাধকের উত্তরসূরি। ফলে এই গ্রামের বেশিরভাগ পুজোই পুরুষানুক্রমে হয়ে আসছে। গ্রামের অন্যতম প্রাচীন পুজো সিদ্ধেশ্বরী কালী। অনেক আগে সিদ্ধেশ্বরী কালীর বিগ্রহ ছিল পাথরের। পরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে সেটি কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমন প্রাচীন পুজোর সংখ্যা নেহাত কম নয়। রয়েছে সাধক রামচন্দ্রের চার পুত্রের উত্তরাধিকারীদের পুজো। যেগুলি এলাকায় বড়বাড়ি, মেজোবাড়ি, ন’বাড়ি এবং ছোটবাড়ি নামে পরিচিত। এর মধ্যে ন’বাড়িতে আছে রামচন্দ্রের সময়ের প্রাচীন ‘মহাশঙ্খের জপমালা’। গোটা গ্রামে ওই মালা নিয়ে চমৎকার সব কাহিনী শোনা যায়। বলা হয়, অমাবস্যার রাতে সধবা চণ্ডাল রমণীর অপঘাতে মৃত্যু হলে তার খুলির টুকরো দিয়ে ওই জপমালা তৈরি হয়েছিল। মালায় সুতো হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ওই মৃতা চণ্ডালিনীর নাড়ি। দ্বীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে ওই জপমালার বিশেষ পুজো হয়। মানুষ ভিড় জমান তা দেখতে।

তবে কৃষিপ্রধান এই গ্রামের তিনশো বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের পুজোয় লেগেছে বদলের ছোঁয়া। হ্যাজাক-ডে-লাইটের বদলে এলইডি আলোর রোশনাই। ঢোল-সানাইয়ের মেঠো সুর ডুবে গিয়েছে দৈত্যাকার ডিজে বক্সের শব্দে। নিকানো উঠোনে চাঁদোয়া টাঙিয়ে পুজো আর হয় না। বদলে মণ্ডপ দিয়ে আকাশ দখলের লড়াইয়ে মেতেছে বেলপুকুরের বারোয়ারি পুজো। প্রবীণ বাসিন্দাদের চোখে এখনও ভাসে ঘুটঘুটে অন্ধকার অমাবস্যার রাতে ঝোপঝাড়ে ভরা গ্রামের আনাচকানাচে কালীপুজোর আয়োজন। গভীর রাতে প্রদীপ জ্বলা মাটির ঘরে পুজোয় বসা পুরোহিতের গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে ঢাকের আওয়াজে কেমন যেন গা ছমছম করত। পুজোর দিন সূর্যাস্তের পর থেকেই গোটা গ্রাম বদলে যেত। এখন আর তেমন হয় না। তবে পুজোকে ঘিরে গ্রামের মানুষের আবেগ আজও অপরিবর্তিত। রুটি-রুজির টানে গ্রামের অনেকেই বাইরে থাকেন। এই কালীপুজোর সময়েই তাঁরা বাড়ি ফেরেন। বেলপুকুরের বাসিন্দা বাপি ভট্টাচার্য বেশ কয়েকদিন আগেই বাড়ি চলে এসেছেন। তাঁর কথায়, “বহু বছর ধরে গ্রামের বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে। সেই পুজোর জন্য সম্বৎসর আমরা অপেক্ষায় থাকি।”

বেলপুকুরের পশ্চিম দিকে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গঙ্গা পাড় হলেই চৈতন্যের নিজের দেশ নবদ্বীপ। এই নবদ্বীপেই চৈতন্য জন্মের কয়েক দশকের মধ্যেই জন্মালেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর প্রভাবে বঙ্গদেশে শক্তি সাধনার ধারার আমূল বদল ঘটে গেল। তিনি মহাপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। সমস্ত তন্ত্রের সার সংকলন করে রচনা করে ছিলেন ‘বৃহৎতন্ত্রসার’। শক্তির আরাধনাকে তিনিই প্রথম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। কালীপুজোর রাতে যে দক্ষিণাকালীর পুজো ভক্তেরা করে থাকেন, তার প্রবর্তন করেন আগমবাগীশ। নবদ্বীপে আগমেশ্বরী পাড়ায় আগমবাগীশের পঞ্চমুণ্ডির আসনে আজও সেই কালীপুজো হয়। বলা হয় এটিই নাকি প্রথম এবং প্রাচীনতম দক্ষিণাকালীর পুজো। আগমবাগীশের মতো করে তাঁর নির্দেশিত পথে পুজোর যাবতীয় আয়োজন হয়। কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমীতে খড় বাঁধা দিয়ে মূর্তি নির্মাণের সূচনা হয়। একাদশীতে পাঁচপোয়া খড়ের বিশেষ ধরনের অবয়ব বিরাটাকার প্রতিমার বুকে স্থাপন করা হয়। অমাবস্যা লাগলে চক্ষুদান। একটা সময়ে পুজো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিসর্জন হত। এখন দুপুরের মধ্যেই বিসর্জন শেষ হয়।

শহরের আর এক প্রাচীন পুজোর প্রচলন করেন তান্ত্রিক ভৃগুরাম। ঢাকার বিক্রমপুর থেকে যাওয়ার পথে নবদ্বীপের গঙ্গায় নৌকাডুবি হয়ে বর্তমান নবদ্বীপের দক্ষিণ অঞ্চলে আসেন ভৃগুরাম। তৎকালীন নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দের একটি সমস্যা অলৌকিক ভাবে সমাধান করে তিনি রাজার বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠেন। রাজা তাঁকে নবদ্বীপের একটি মৌজা উপহার দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ভৃগুরামের তিন ছেলের নামে এই এলাকার নাম হয় ‘তেঘরি’। তাঁর সাধনস্থল ‘শ্যামাপিড়িতে’ পুরুষানুক্রমে তাঁর উত্তরসূরিরা কালী পুজো করে আসছেন। তাঁর বংশের দশম পুরুষ দেবকুমার ভট্টাচার্য বলেন, “এই পুজো তাঁর রচিত ধ্যানমন্ত্রে একই ভাবে হয়ে আসছে।” হাজার বছরের প্রাচীন জনপদে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক ঐতিহাসিক কালী পুজোর কাহিনী।

বেলপুকুর থেকে সামান্য দূরে ধুবুলিয়াতেও কালী পুজোর আড়ম্বর চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় দেশবন্ধু স্কুলের মাঠে বিনয় সঙ্ঘ, সমাজ সেবক সঙ্ঘ, ক্ষুদিরাম সঙ্ঘ, ফ্রেন্ডস ক্লাব, সৎকার সমিতি, রক্তজবা ক্লাব, ইয়ং স্টার, অগ্রণীর মতো ক্লাবগুলোর পুজোর জাঁকজমক দর্শনার্থীদের মন কাড়ে। ধুবুলিয়ার এই কলোনি এলাকার পুজোর পত্তন প্রসঙ্গে সমাজ সেবক সঙ্ঘের অন্যতম কর্মকর্তা রঞ্জু ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘দেশভাগের পর ওপার বাংলার বহু মানুষ ধুবুলিয়ার বিভিন্ন কলোনিতে বসবাস শুরু করেন। তারপর থেকেই এই কালীপুজো নিয়মিত হচ্ছে।”

kali pujo belpukur debasish bandyopadhyay manirul seikh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy