Advertisement
E-Paper

পাচারে হাতিয়ার খুদেরা, মানছে পুলিশ

কয়েক বছর আগের কথা। ডিসেম্বরের হাড়হিম করা শীতের সকাল। আদিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার চর ঢাকা পড়ে আছে কুয়াশার ঘন চাদরে। সেই কুয়াশা ভেদ করে ছায়া মানুষের মতো হেঁটে চলেছে দুই খুদে সহোদর। মুন্না ও রেশমি। (নাম পরিবর্তিত)। দাদা মুন্না চতুর্থ শ্রেণির ও বোন রেশমি তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। চাদরে মোড়া দুই খুদের মাথায় ঘাসের বোঝা। পায়ের উপর দিয়ে বইছে হাঁটু-জল পদ্মা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৭

কয়েক বছর আগের কথা। ডিসেম্বরের হাড়হিম করা শীতের সকাল। আদিগন্ত বিস্তৃত পদ্মার চর ঢাকা পড়ে আছে কুয়াশার ঘন চাদরে। সেই কুয়াশা ভেদ করে ছায়া মানুষের মতো হেঁটে চলেছে দুই খুদে সহোদর। মুন্না ও রেশমি। (নাম পরিবর্তিত)। দাদা মুন্না চতুর্থ শ্রেণির ও বোন রেশমি তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। চাদরে মোড়া দুই খুদের মাথায় ঘাসের বোঝা। পায়ের উপর দিয়ে বইছে হাঁটু-জল পদ্মা। নালার মতো বয়ে চলা ওইু নদী পার হলেই মুন্না ও রেশমি পৌঁছে যাবে বিশ্বনাথপুরে নিজেদের বাড়ি। তা হলেই গবাদি পশুর মুখে জুটবে খাবার সতেজ সবুজ ঘাস।

দুই খুদের পাতে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য হতদরিদ্র বিধবা মা হাওয়া বেওয়া (নাম পরিবর্তিত)-র হাতের তালুতে জমা পড়বে ৫০০ টাকার কড়কড়ে একটি নোট। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মরা নদীর তিরতিরে স্রোতে দুই শিশুর পা পড়তেই কুয়াশা ফুঁড়ে হাজির মূর্তিমান আতঙ্ক। বেয়নেট উঁচিয়ে হাঁক পাড়েন বি এস এফের দুই জওয়ান, “আব রুখ্ যা!”

ঘাসের বোঝা থেকে বেরিয়ে এল দু’ প্যাকেট হিরোইন। খবর গেল হতদরিদ্র হাওয়া বেওয়ার কাছে। পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন তিনি। মা ও বেটাবিটি মিলে তিন জনে জওয়ানদের পায়ে পড়ে সে কী কান্না!

অবশেষে দয়াপরবেশ হয়ে জওয়ানরা হেরোইনের দুই খুদে ‘ক্যারিয়ার’কে মুক্তি দিলেন। কিন্তু মুল কারবারি কে? জওয়ানের প্রশ্ন, “আব বুলাও!” ফের জওয়ানের পায়ে লুটোপুটি। কান্নায় ভেঙে পড়ে হাওয়া বেওয়ার সকরুণ আর্তি, “হুজুর নাম করতে পারব না। নাম করলেই খুন করে দেবে। আমার ছেলেমেয়ে অনাথ হয়ে যাবে হুজুর!” সে যাত্রা পেহাই পেল দুই অবোধ শিশু। কিছুটা একই ভাবে লালগোলার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীও পার পেয়ে গিয়েছে।

কয়েক বছর আগের ঘটনা। পরনে স্কুল ইউনিফর্ম। পিঠে বই বোঝাই স্কুলব্যাগ। ঘোড়ায় টানা টমটমে চেপে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীটি চলেছে স্কুলে। গোপন খবর ছিল পুলিশের কাছে। পথের মাঝে টমটম থামিয়ে স্কুলব্যাগ হাতড়ে পুলিশ বের করল হেরোইনের প্যাকেট। যার বাজার দর ৯০ লক্ষ টাকা। সমবেত জনতার সনির্বন্ধ অনুরোধে জেলের ঘানি টানা থেকে রক্ষা পেল ওই নাবালিকা ‘ক্যারিয়ার’।

এ ক্ষেত্রেও খুন হয়ে যাওয়ার সমূহ আতঙ্কে হেরোইনের আসল কারবারির নামধাম পুলিশের অগোচরেই রয়ে গেল। ওই তিন খুদে পড়ুয়ার মতো ভাগ্যের জোর অবশ্য ছিল না কলেজ পড়ুয়া দুই ছাত্রের। গত ২৪ ডিসেম্বরের ভোর। রহস্যময় কুয়াসায় ঢেকেছে চরাচর। সূর্যের আলো ফুটলেও চোখের সামনে ১০ হাত দূরে ঘন আঁধার। ‘হেড লাইট’ জ্বালিয়ে কুয়াশা ভেদ করে লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্য সড়কে অল্পবিস্তর যানবাহন চলছে। আলো জ্বালিয়ে মোটর বাইকে করে ছুটছে গ্রামের দুই টগবগে তরুণ। ‘সোর্স’-এর কাছ থেকে পাওয়া খবর ছিল পুলিশের কাছে। বাহিনী নিয়ে ওই সড়কের পণ্ডিতপুর মোড়ের কাছে ঝোপের আড়ালে ওঁত পেতে ছিলেন লালগোলার তৎকালীন ওসি রবি মালাকার। তাঁদের হাতে ধরা পড়ল সম্ভবনাময় দুই উজ্জ্বল ছাত্র।

পুলিশের কথায়, মধ্যবিত্ত পরিবারের ওই দুই ছাত্রের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৫৫ লক্ষ টাকার হেরোইন। বিচারাধীন ওই দুই ছাত্র এখন জেলে।

বাংলাদেশে পাচার হতে চলেছে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের হেরোইন। ‘সোর্স’-এর কাছ থেকে সেই খবর পেয়ে গত বুধবার রাতে কলকলি নদীর ধারে সাদা পোশাকের বাহিনী নিয়ে জাল বিছিয়ে অপেক্ষা করছিলেন লালগোলার বর্তমান ওসি জামালুদ্দিন মণ্ডল। অবশেষে সেই জালে ধরা পড়ল লালগোলার এক ছাত্র। ধরা পড়েছে মূল কারবারিও। ওই দু’জনের কাছ থেকে পুলিশ উদ্ধার করে প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৩ কেজি হেরোইন।

ওসি জামালুদ্দিন মণ্ডল বলেন, “পুলিশকে বোকা বানাতে ওই হেরোইনের প্যাকেট গুলো মোড়া ছিল শিশুখাদ্য ও দামি চায়ের প্যাকেটে। ওই হেরোইন এসেছে রাজস্থান থেকে।”

একটা সময় হেরোইনের ‘ক্যারিয়ার’ হিসাবে মহিলাদের ব্যবহার করা হত। পাচারকারীরা কৌশল পাল্টে সম্প্রতি ‘ক্যারিয়ার’ হিসাবে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বেশি পছন্দ করছে। কিন্তু কেন?

মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “ইতিপূর্বে অনেক মহিলা ক্যারিয়ার গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ সতর্ক থাকায় পুরনোদের বাদ দিয়ে ক্যারিয়ার হিসাবে নিত্য নতুন মুখ চায়। তাই নিষ্পাপ মুখের ছাত্রছাত্রীদের দিকেই হেরোইনের কারবারিরা ঝুঁকেছে।”

বিএসএফের এক কর্তা অবশ্য অন্য একটা যুক্তিও দেখাচ্ছেন। ওই কর্তা জানান, একটা সময় মহিলাদের দিয়ে পাচার করানো ছিল সবথেকে নিরাপদ। কারণ মহিলাদের তল্লাশি করার ক্ষেত্রে বিএসএফের অনেক অসুবিধা ছিল। বছর কয়েক আগেও মহিলা বিএসএফ ছিল না। কোনও মহিলা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে বসিয়ে রেখে খবর দেওয়া হত স্থানীয় থানায়। সেখান থেকে মহিলা কনস্টেবল এলে তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ করা হত। তাতে যেমন সময় নষ্ট হত তেমনই ঝুঁকিও ছিল। বিএসএফের ওই আধিকারিকের কথায়, “এখন অবশ্য মহিলা বিএসএফ আসার পরে ওই সমস্যা মিটেছে। তারপর থেকেই মহিলাদের বাদ দিয়ে শিশু কিংবা স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

তবে ছাত্রছাত্রীরা কেন সেই পাচারের মরণ ফাঁদে পা দিচ্ছে? লালগোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অজয় ঘোষ ও স্থানীয় লস্করপুর হাইস্কুল শিক্ষক আশরাফ আলি রাজবী বলেন, “দারিদ্র একটা কারণ বটে! তার চেয়ে বড় কারণ লোভ। ১০০ দিনের কাজ করে এক দিনে মিলবে ১৫১ টাকা। তার থেকে কম সময়ে ক্যারিয়ারের কাজ করে মিলবে কয়েক হাজার টাকা। তাতে মোটরবাইক থেকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল- সহ যাবতীয় বাসনা পূরণ হবে। অভিজাত হোটেল ও রেস্তোরার রেস্ত জুটবে। আর সেই ফাঁদেই কোনও কিছু না ভেবে পা দিচ্ছে বহু পড়ুয়া।”

trafficking children berhampore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy