Advertisement
০২ মে ২০২৪

পাটের দাম মেলেনি, উৎসবের মরসুমে প্রভাব পড়েছে বাজারে

বরুণদেব নাকি এবার বর্ষায় গত কয়েক বছরের তুলনায় একটু বেশিই কৃপা করেছেন এ রাজ্যের তেতেপুড়ে থাকা মানুষগুলোকে। দিনের হিসেবে গত বছরের তুলনায় বৃষ্টি হয়ত ক’দিন বেশি হয়েছে। কিন্তু সাদা চোখে দেখা এই ‘বেশি বৃষ্টি’ মোটেই খুশি করতে পারেনি রাজ্যের পাট চাষীদের। একদিকে জলের অভাবে সঠিক সময়ে পাট কাটতে পারেননি বহু চাষি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৪
Share: Save:

বরুণদেব নাকি এবার বর্ষায় গত কয়েক বছরের তুলনায় একটু বেশিই কৃপা করেছেন এ রাজ্যের তেতেপুড়ে থাকা মানুষগুলোকে। দিনের হিসেবে গত বছরের তুলনায় বৃষ্টি হয়ত ক’দিন বেশি হয়েছে। কিন্তু সাদা চোখে দেখা এই ‘বেশি বৃষ্টি’ মোটেই খুশি করতে পারেনি রাজ্যের পাট চাষীদের।

একদিকে জলের অভাবে সঠিক সময়ে পাট কাটতে পারেননি বহু চাষি। অন্যদিকে যাঁরা পাট কাটতে পেরেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার বাজারে পাটের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় পাট বিক্রি করেননি। ইতিমধ্যেই কেটে গিয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এমনকী একেবারে গায়ে গায়েই এসে পড়েছে ঈদও। তবু তেমন জমেনি কেনাকাটা। তাই পাটচাষীদের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছুটা লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছে ব্যবসায়ীদেরও। উৎসব শেষে হিসাব মেলাতে বসে জেলা সদর বা মফফস্বলের ব্যবসায়ীদের কপালে গভীর ভাঁজ।

কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে বর্ষার শুরু থেকেই নিয়মিত। কমবেশি বৃষ্টি হয়েছে গোটা রাজ্যজুড়েই। বৃষ্টিপাতের এই ধরন ধান-সহ প্রায় সব ধরনের ফসলের জন্য অনুকুল পরিস্থিতি তৈরি করে বলে মনে করছেন সাধারণ কৃষক থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞ সকলেই।

কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু পাট। চলতি মরসুমের বৃষ্টিপাত পাট পচানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন জেলার পাটচাষিরা। পাট পচানোর জল নিয়ে এ বছরও সমস্যায় পড়েছেন পাটচাষীরা। তবে এই সমস্যা সব জেলায় একরকম নয়। যেমন কয়েক বছরের তুলনায় বধর্মানের চাষিদের এবার অনেকটাই কম সমস্যার হয়েছে। সেখানে পুজোর আগেই অধিকাংশ জমির পাটকাটা হয়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন জেলার কৃষিকর্তারা।

কিন্তু পাশের জেলা নদিয়াতেই বহু জমিতে পাট কাটা সম্ভব হয়নি স্রেফ জলের অভাবে। নদিয়া মুর্শিদাবাদের যুগ্ম কৃষি আধিকর্তা হরেন্দ্র কুমার ঘোষ যেমন বলেন, “নদিয়া জেলার তুলনায় মুর্শিদাবাদের পাটের অবস্থা কিছুটা ভালো। নদিয়ার কিছু অঞ্চলে চাষিরা পুজো বা ঈদের আগে পাট কাটতে পারেননি।”

নদিয়ার বড় আন্দুলিয়ার কৃষক রবীন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, “এ বছরের বৃষ্টি পাটচাষের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাপ উপর বৃষ্টি সর্বত্র সমান হয়নি। চাপড়া, বার্নিয়া, পলসোন্দা, বড় আন্দুলিয়ার কোথাও নয়নজুলি পর্যন্ত ভরেনি। সেই জল মেশিন দিয়ে তুলে পাট পচাতে হয়েছে।” ফলে পাট পচানোর খরচও বেড়ে গিয়েছে এক লাফে। এমনিতেই চাষের খরচ বেড়েছে বহুগুণ, তাই লাভের মুখ দেখা আর হয়ে উঠেনি চাষিদের।

অথচ বর্ধমানের পারুলিয়ার কৃষক পরিমল দেবনাথ বলেন, “এবার আমাদের জেলায় জল নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। প্রায় সব জায়গায় পাট কাটা হয়ে গিয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষেই। কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্য জায়গায়। বাজারে চাষি পাটের দাম পাচ্ছে কই না।”

জমিতে সার, বীজ, ওষুধ, মজুরি, সেচ সব দিয়ে কুইন্ট্যাল প্রতি পাটচাষের খরচ তিন হাজার টাকার বেশি বলে চাষিদের দাবি। অথচ চলতি মরসুমে নতুন ভালো জাতের পাট কুইন্ট্যাল প্রতি গড়ে ২৪০০-২৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গুণগত মান অনুযায়ী এই দাম ক্রমশ নামতে থাকে। এই অবস্থায় পাট বিক্রি করে লাভের মুখ দেখার ভরসা চাষিরা মোটেই করছেন না। বর্ধমানের সহ-কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “অল্প বা ঘোলা জলে পচানোর ফলে পাটের গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। ফলে উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।”

তারই জের পড়েছে নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগর মতো এলাকার বাজারে। এসব এলাকার ক্রেতাদের বড় একটা অংশ আসেন সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল থেকে। সেই গ্রামীণ ক্রেতার হাজিরা এবার ছিল মাঝারি সংখ্যায়। স্থানীয় ব্যবসায়রীরা জানান সাধারণত মহালয়ার পর থেকে গ্রামীণ ক্রেতাদের পুজোর বাজারের ভিড়টা শুরু হয়। এবার কিন্তু পুজোর বাজারে কোনও সময়েই তেমন চাপ তৈরি হয়নি। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা বলেন, “দুর্গাপুজো বা ঈদের মতো উৎসবে সব বাঙালিকেই কিছু না কিছু কিনতে হয়। সেই হিসেবে যেটুকু কেনাকাটা না করলে নয় গ্রামীণ ক্রেতারা তার বেশি করেননি, করতে পারেননি।”

এই সময় চাষিদের পাট বেচার টাকাটাই ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় বাজারে। এবারে কিন্তু সেই হিসাব মেলেনি। শুধু এবার বলে নয়, কয়েক বছর ধরেই ছবিটা নাকি একই রকম। যদিও ছোটবড় সব ব্যবসায়ী আশা করেন পুজোর মরশুমে বছরের সেরা ব্যবসাটা করবেন। কিন্তু পুজোর আগে পাট উঠে চাষিদের হাতে নগদ টাকা আসার প্রচলিত ফর্মুলা ক্রমশ অকার্যকরী হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন উঠছে বাঙালির গ্রামীণ অর্থনীতিতে পাট কি গুরুত্ব হারাচ্ছে?

এ বিষয়ে নদিয়া ডিষ্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-র সম্পাদক গোকুল বিহারী সাহা বলেন, “পাটের দাম চাষিরা পাবেন কী করে, কিনবে কে? একের পর এক জুটমিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাটের চাহিদার পরিসর ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। পাটের জায়গা নিয়েছে সিন্থেটিক ব্যাগ।”

প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথ কুমার দে বলেন, “বছর বছর পাট চাষে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চাষিরা আগ্রহ হারাছেন পাট চাষে। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নদিয়া, বর্ধমান বা মুর্শিদাবাদের মতো জেলা গুলির ব্যবসা বাণিজ্যে। নেহাত ওই সময়ে আর কোনও ফসল হয় না তাই বাধ্য হয়ে এখনও পাটচাষ করছেন। তবে কতদিন করবেন সেটা বলা মুশকিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jute price market debasish bandyopadhyay nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE