Advertisement
০২ মে ২০২৪

প্রসূতি সুস্থই, মৃতদেহ নিতে ডাকল চিঠি

হাতে একটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের এক কর্মী জানিয়েছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যান। আপনার বৌমা মারা গিয়েছে।’ শুক্রবার সাতসকালে এমন মৃত্যু সংবাদ শুনে কান্নার রোল ওঠে উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহর পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মেঘনী মাহাতোর বাড়িতে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন বছর ষাটেকের ওই বৃদ্ধাও। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে তড়িঘড়ি জনাকয়েক প্রতিবেশীকে নিয়ে তিনি রওনা দেন কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে।

হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথে পার্বতী মাহাতো। —নিজস্ব চিত্র।

হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথে পার্বতী মাহাতো। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রানাঘাট শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৫১
Share: Save:

হাতে একটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের এক কর্মী জানিয়েছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যান। আপনার বৌমা মারা গিয়েছে।’

শুক্রবার সাতসকালে এমন মৃত্যু সংবাদ শুনে কান্নার রোল ওঠে উত্তর ২৪ পরগনার হালিশহর পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মেঘনী মাহাতোর বাড়িতে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন বছর ষাটেকের ওই বৃদ্ধাও। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে তড়িঘড়ি জনাকয়েক প্রতিবেশীকে নিয়ে তিনি রওনা দেন কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে।

হাসপাতালে এসে তিনি দেখেন, কোলে সদ্যোজাত নাতিকে নিয়ে ভ্যানরিকশায় বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছেন বৌমা, পার্বতী মাহাতো। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ছেলে হরিকিশোরও। লেখাপড়া না জানা মেঘনীদেবী ইংরেজিতে লেখা চিঠির বয়ান বুঝতে না পারলেও হাসপাতালে এসে তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অথবা পুলিশের নিশ্চয় কোথাও একটা ভুল হয়েছে।

ভুল যে হয়েছে সে কথা কবুল করছেন সকলেই। তবে সেই ভুলের দায় কার তা নিয়ে শুরু হয়েছে চাপানউতোর। কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালের ডেপুটি সুপার স্নেহপ্রিয় চৌধুরী বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে কারও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পুলিশের মাধ্যমেই সেই রোগীর বাড়িতে খবর পৌঁছে দেওয়াই এই হাসপাতালের দস্তুর। এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই করা হয়েছিল। কিন্তু থানা থেকে কী ভাবে অসুস্থতার খবর মৃত্যুতে বদলে গেল সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।” বিষয়টি জানতে তিনি নিজে থানায় যাবেন বলেও জানান। কল্যাণীর এসডিপিও রানা মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তবে ভুল তো একটা হয়েছেই। সেটা কাদের ভুল এবং কী ভাবে হল সেটা আমরাও খতিয়ে দেখছি।”

ভুল শুধু মৃত্যুসংবাদে নয়। বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে মাহাতো পরিবারে পাঠানো চিঠিতেও। থানা থেকে পাঠানো ওই চিঠির নীচে ওয়ার্ড মাস্টার হিসাবে নাম লেখা রয়েছে সুভাষ ঠাকুরের। অথচ হাসপাতাল কতৃর্পক্ষ জানিয়েছেন, সুভাষবাবু আদতে ওয়ার্ড বয়, ওয়ার্ড মাস্টার নয়। তাঁর মাধ্যমেই অসুস্থতার খবর পাঠানো হয়েছিল পুলিশের কাছে।

কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জানান, হাসপাতালে একটি খাতা রয়েছে। রোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হলে ওই খাতায় রোগীর নাম ঠিকানা ও বাড়ির লোকজনতে তলবের কারণ লিখে সেই খাতা পাঠানো হয় স্থানীয় থানায়। থানা সেই খাতায় তাদের সিল মেরে প্রাপ্তিস্বীকার করে। তারপর তারাই চিঠি দিয়ে সেই রোগীর বাড়ির লোকজনকে বিষয়টি জানায়। তবে এ ক্ষেত্রে তথ্যের বিকৃতি ঘটাতেই এমন বিপত্তি। তবে হাসপাতালের এমন দস্তুর শুনে রীতিমতো বিস্মিত রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে। তিনি জানান, রোগীর পরিবারের কারও ফোন নম্বর থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তো রোগীর বাড়িতে ফোন করে খবর দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে তা তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান স্বাস্থ্যসচিব।

ঠিক কী ঘটেছিল? পুলিশ ও হাসপাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে কল্যাণী জওহরলাল নেহরু হাসপাতালে ভর্তি হন পার্বতীদেবী। এ দিনই দুপুরে তিনি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তারপর মা ও শিশু দু’জনেই সুস্থ ছিল। চিকিৎসকেরা জানান, রাতের দিকে হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয় পার্বতীদেবীর। সেই সময় ওই মহিলার সঙ্গে বাড়ির কেউ ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠানো হয় কল্যাণী থানায়। সেখান থেকে খবর যায় বীজপুর থানায়। গোলমালটা শুরু হয় তার পরেই।

পার্বতীদেবীর শাশুড়ি মেঘনীদেবী জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলেই তাঁরা পার্বতীদেবী ও সদ্যোজাতকে দেখে বাড়ি ফিরেছিলেন। তখনও পর্যন্ত সকলেই সুস্থ ছিল। শুক্রবার সকালে বীজপুর থানার এক পুলিশকর্মী তাঁর হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। কী লেখা আছে জানতে চাওয়ায় ওই পুলিশকর্মী তাঁকে জানান যে, পার্বতীদেবী আর নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে হবে। ওই বৃদ্ধা বলেন, “খবরটা শোনার পরে মনে হয়েছিল পায়ের তলায় আর মাটি নেই। পরে লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসি।”

পার্বতীদেবীর স্বামী, ভ্যানচালক হরিকিশোর এ দিন সকালেই হাসপাতালে চলে এসেছিলেন স্ত্রী ও পুত্রকে দেখতে। তিনি আসার পরেই বাড়িতে পুলিশ যায়। ফলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। বাড়ির ও পাড়ার লোকজনকে হাসপাতালে ছুটে আসতে দেখে তিনিও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।

হরিকিশোর বলছেন, “বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তারপর তো মায়ের মুখেই সব শুনলাম।” মেঘনীদেবী অবশ্য বৌমা ও নাতিকে ভ্যানরিকশার উপর বসে থাকতে দেখে আনন্দে ফের কেঁদে ফেলেন। পার্বতীদেবী বলেন, “কাঁদছেন কেন মা? এই দেখুন আমরা সবাই ভাল আছি। চলুন, বাড়ি যেতে হবে। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।”

বৌমা ও নাতির সঙ্গে ভ্যানের উপর উঠে বসেন মেঘনীদেবীও। বাড়ির পথে যেতে যেতে বলেন, “যারা বলেছিল বৌমা মারা গিয়েছে, তাদের মুখে ছাই পড়ুক।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pregnant woman jawaharlal nehru memorial hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE