Advertisement
০৭ মে ২০২৪

বাহারি কম্বলের বহরে রুজি হারাচ্ছেন ধুনুরিরা

বছর দশেক আগেও শীতের দুপুরের নীরবতা ভেঙে যেত একটানা ধুনুরির শব্দে। পুজোর মরসুম শেষ হলেই পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলত ওদের। হাতে তুলোর ‘ধোনাই যন্ত্র’। ডগার দিকে ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে যাওয়া বাঁশের চকচকে একটা লাঠি থেকে ঝুলন্ত লাল কাপড়ের পুঁটলি।

এখনও আসেন, কিন্তু কাজ মেলে না। নবদ্বীপে নিজস্ব চিত্র।

এখনও আসেন, কিন্তু কাজ মেলে না। নবদ্বীপে নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যয়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৮
Share: Save:

বছর দশেক আগেও শীতের দুপুরের নীরবতা ভেঙে যেত একটানা ধুনুরির শব্দে। পুজোর মরসুম শেষ হলেই পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলত ওদের। হাতে তুলোর ‘ধোনাই যন্ত্র’। ডগার দিকে ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে যাওয়া বাঁশের চকচকে একটা লাঠি থেকে ঝুলন্ত লাল কাপড়ের পুঁটলি। তার মধ্যে পাট করে সাজানো লেপ তৈরির হাল্কা কাপাস কিম্বা বালিশ তৈরির শিমূল তুলো। সঙ্গে নানা ধরনের লাল ‘শালু’ কিম্বা ‘বাঁদিপোতার’ সস্তা খোপকাটা কাপড়। হেমন্তের হিম হিম সকালে বাড়ির ছাদে কিম্বা উঠোনে স্তূপাকার তুলো ধুনে সুরেলা শব্দে মিহি রোঁয়া উড়লেই বোঝা যেত শীত আসছে।

বংশপরম্পরায় বিহারের সমস্তিপুর, মোতিহারি, মজঃফরপুর, বেগুসরাই থেকে মানুষগুলো ছুটে আসতেন শীতার্ত বাঙালির শীত নিবারণ করতে। বিনিময়ে সামান্য কিছু উপার্জন। তখনও লেপ তোষকের জন্য শহর-আধা শহর, গ্রাম বা মফঃস্বলের মানুষ সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করত ধুনুরিদের উপর। পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জির উপর ছেঁড়া ফতুয়া বাঙালি আদর করে ডাকত ‘ফুফা’ বলে।

কিন্তু এখন ছবিটা বদলে গিয়েছে অনেকখানি। আজও দু’একজন ধুনুরির দেখা পাওয়া যায় শীত শীত একলা দুপুরে। কিন্তু তাঁদের উপার্জন নিতান্তই কমে গিয়েছে বললেও কম বলা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মজুরি বেড়েছে, কিন্তু কমে গিয়েছে চাহিদা। ফলে বিপন্ন ওই ধুনুরি সম্প্রদায়।

চল্লিশ বছর ধরে লেপ তোষক তৈরি করতে বাঙলায় আসছেন মহম্মদ লতিফ এবং মহম্মদ সমীর। প্রবীণ দুই ধুনুরি জানান, বছর দশ বারো আগেও শীতের মরশুমে কাজের চাপে দিনভর নাওয়া-খাওয়ার সময় পেতেন না। এক একজন দিনে চারটে পাঁচটা পর্যন্ত লেপ তৈরি করতেন। মহম্মদ লতিফের কথায়, “সকাল আটটায় কাজ শুরু করেও শেষ করতে রাত ন’টা বেজে যেত। ৮০-৯০ জন মিলে কাজ করে কুল পেতাম না। দৈনিক চার-পাঁচশো টাকার কাজ প্রায়দিন হতো। কিন্তু তারপর কি যে হল, লোকের পছন্দ বদলে গেল। লেপের বদলে প্রথমে কিছুদিন বাজারে এলো বালাপোশ। আর এখন কম্বলের বাজার। লেপ আর কেউ চাইছে না।”

‘ফুফা’দের এ আক্ষেপ মিথ্যে নয়। শহর থেকে লেপ বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। এখন মফঃস্বল এমনকী গ্রাম থেকেও। শীত পড়তেই বাড়ির ছাদে তুলো উড়িয়ে লাল টকটকে শালুতে লেপ তৈরির দিন শেষ। জায়গা নিয়েছে বাহারি কম্বল। রকমারি সাইজ এবং রঙের এসব কম্বলের দামও নাগালের মধ্যেই। মূলত লুধিয়ানা থেকে আমদানি এসব কম্বলের চাহিদা আকাশ ছোঁয়া। সদ্যজাত থেকে সদ্য বিবাহিত সকলের জন্যই কম্বলের চাহিদা বাড়ছে।

এই বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহম্মদ মজলুম, মহম্মদ এরশাদ বা মোস্তাকিম মহম্মদদের যাতায়াত ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ধুনুরির কাজকে ওরা বলেন ‘খানদানি পেশা’। কেউ ৩০, কেউ ৪০ বছর ধরে এই কাজ করতে ‘বাঙলা মুলুকে’ আসছেন। ঠাকুরদার হাত ধরে বাবা এবং বাবার হাত ধরে মোস্তাকিম নবদ্বীপে আসছেন ১৫ বছর ধরে। তিনি বলেন, “আমাদের ওখানে সবাই এই কাজ করে। মোটামুটি হাঁটতে শিখলেই আমাদের পরিবারের ছেলেরা এই কাজে হাত পাকাতে শুরু করে।” কম বেশি ছয় মাস এখানে থাকেন। গরম পড়লেই ফিরে যান দেশে। বর্ষা শেষে হেমন্তের শুরুতে ফিরে আসেন বেশির ভাগ ধুনুরি। তবে কেউ কেউ সারা বছর থেকে যান কোনও দোকানের কর্মী হিসেবে। বিহারে গিয়ে সাধারণত খেত-খামারে এবং ইটভাঁটায় শ্রমিকেরা কাজ করেন। তবে সে কাজে ওদের মন লাগে না।

অথচ এই কাজের অবস্থা খুব খারাপ। এখানে তো কাজই নেই নিজেরাই সন্দিহান মহম্মদ লতিফ বা সমীরের মতো কারিগরেরা। তারা বলেন, “আমারা সব সময় লেপ বা তোশক পিছু মজুরি নিয়ে থাকি। প্রথম দিকে ১৫ বা ২০ টাকা ছিল মজুরি। তখন দিনে ১৫০ টাকা উপার্জন কোনও ব্যাপার ছিল না। এখন ২০০ টাকা মজুরি। কিন্তু রোজ কাজই জোটে না।” সারাদিন কাজের সন্ধানে টোটো করে ঘুরে বেড়ানো। দিনের বেলায় খাবার বলতে চিঁড়ে মুড়ি। রাতে একসঙ্গে সকলে মিলে একটা সব্জি, ডাল আর ভাত। মহম্মদ মজলুম বলেন, “দিনে খাওয়া খরচ গড়ে একশ টাকা। অথচ রোজগারের ঠিক নেই। কতদিন যে মাছ খাই না। এই অবস্থায় আর কতদিন আসা যাবে জানি না।”

কিন্তু কেন এমন হল? ব্যবসায়ী রাজা দাস বলেন, “মানুষের রুচি চাহিদা বদলেছে। নানা কারণে বাড়ছে কম্বলের চাহিদা।” প্রথমত দামে অনেক সস্তা হয় কম্বল। একজন ব্যবহারের একটা লেপ গড়াতে যেখানে ৯০০ থেকে হাজার টাকা খরচ, সেখানে সাতশো টাকায় মনের মতো কম্বল হবে। দেখতেও অনেক ‘স্মার্ট’। লেপের তুলনায় অনেক হাল্কা এবং সহজে ভাঁজ করে রাখা যায় বলে সহজেই জনপ্রিয় হচ্ছে কম্বল। সে ক্ষেত্রে দামের পরোয়া করেন না অনেক ক্রেতাই। রাজাবাবুই জানালেন, “একটু বেশি দামের বিদেশি কম্বলের জন্য দু’আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে ক্রেতাদের কোন আপত্তি দেখছি না।”

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের লেপ-তোষক ব্যবসায়ী আরিফ মনসুর বলেন, “বছর কয়েক আগেও শীতের মরশুমে আমার নিজের ২৫ জন লেপের কারিগর লাগত। গত বছরে কমে সেটা হয়েছিল দশজন। এবার সেটা তিনজনে ঠেকেছে। আসলে লেপ আর পচ্ছন্দ করছেন না মানুষ। ভালো শালু দিয়ে লেপ তৈরি করতে যে খরচ তার থেকে ঢের কম দামে চিনের কম্বল পাওয়া যায়। কেন লোকে লেপ বানাবে বলুন? তাই ওদের কাজ কমে যাচ্ছে।” আর এক ব্যবসায়ি আরিফ মহম্মদ বলেন, “শুধু লেপই নয়, চাহিদা কমছে তুলোর বালিশ, তোশক থেকে ছোবড়ার জাজিমেরও। সকলেই এখন ফোমের গদি বা ফেদারের বালিশ চান।”

তাই আর কিছু করার নেই। লেপের উপর লম্বা ছুঁচ দিয়ে অসামান্য সব নকশা আঁকেন মহম্মদ সমীর, এরশাদ বা লতিফেরা। কখনও শহরের কোনও সুতো রঙ করার গুদাম ঘরে ঝাঁঝালো রাসায়নিকের গন্ধের মধ্যে আবার কখনও বা রাস্তার ধারের কোনও ঢাকা বারান্দায় পুরোন ছেঁড়া কাঁথায় ওদের রাত কাটে লাল টকটকে শালুতে নতুন লেপ তৈরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে। সে স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকটা ক্রমশ বাড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

quilt dhunuri debashis bandopadhay nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE