এই ভবনেই আধুনিক নাট্যমঞ্চ। —নিজস্ব চিত্র।
বর্ষা বিদায় নিয়েছে। চমৎকার করে সাজানো হচ্ছিল বিল্বপুষ্করিণীতে চন্দ্রশেখর আচার্যের উঠোন। নাট্যোৎসবের প্রস্তুতি চলছে। চন্দ্রশেখর ছিলেন নিমাই পণ্ডিতের মেসো। পণ্ডিতদের মতে, সেখানে সে দিন অভিনীত হয় রুক্মিনীহরণ পালা। যেখানে স্বয়ং নিমাই রুক্মিনী সেজেছিলেন। কারও কারও মতে, নবদ্বীপ তো বটেই, বঙ্গদেশে এটাই প্রথম মঞ্চাভিনয়ের প্রয়াস (যদিও অনেক পণ্ডিতের মতে, তার আগেই গৌড়াধিপের রাজসভায় গীতগোবিন্দ পাঠ ও অভিনয় হত)। তারপরে গঙ্গা, জলঙ্গি দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। তবুও এই বর্ষাকালেও মফস্সলের নাটকের দলগুলির টিমটিমে আলো জ্বলা ঘর সন্ধ্যায় এখনও কখনও কখনও গমগম করে। ঘরের ভিতর থেকে ছিটকে আসা সংলাপে অভ্যস্ত মানুষ একে অপরকে বলে, ‘চুপ মহলা চলছে’।
চলছে তো বটে, কিন্তু কী ভাবে?
নাট্যমঞ্চের অভাব, আলো-শব্দের উপকরণ মান্ধাতার আমলের, মেকআপ ও পোশাকের নামমাত্র বন্দোবস্ত, স্থানীয় ডেকরেটরকে দিয়ে করা সেট সেটিং নিয়ে যতটা হয়নবদ্বীপের নাটক ততটাই হচ্ছে। নিধিরাম সর্দারের মতো শুধু ইচ্ছেটুকু সম্বল করে ঢাল-তরোয়াল ছাড়াই নাটক করে চলেছেন নবদ্বীপের নাট্যকর্মীরা। এখন সবচেয়ে বড় ঘাটতি অভিনেত্রীর। মেয়েরা নাটকে আসছেন না। যার ফলে বহু নাট্যদল নাটক হাতে নিয়েও বাধ্য হয়ে বসে আছেন, মঞ্চস্থ করতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সংখ্যায় সব বয়সের পুরুষ অভিনেতাও মেলে না। দলের সামর্থ্যে কুলোয় না বলে ভাল নাটক ধরার সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায়? একই অভিনেতাকে ঘুরে ফিরে একাধিক দলে কাজ করতে হয়। তাতে বাড়ে সাংগঠনিক জটিলতা, মনোমালিন্য। সারা বছরই নাট্যকার, নাটক এবং ভাল পরিচালকের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতে হয় স্থানীয় নাট্যকর্মীদের।
তবুও নাট্যসন্ধ্যার আয়োজন হয়। ‘ফার্স্ট বেল’, ‘সেকেন্ড বেলে’র শব্দে মানুষ তড়িঘড়ি ঢুকে পড়েন নাটকের হলে। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ছোট্ট এক টুকরো মঞ্চে ঘেমে নেয়ে স্নান করতে করতে সংলাপে ডুবে যান নাটকের কুশীলবেরা। গরমে হাঁসফাঁস দর্শক এক সময় বাধ্য হয়ে হাট করে খুলে দেন হলের দরজা। মঞ্চ থেকে একটু দূরে রাখা অস্থায়ী জেনারেটরের শব্দকে পাত্তা না দিয়েই তাঁরা নাটক দেখেন ভালোবেসে। আসলে এই মুহূর্তে নবদ্বীপের নাটকের দলগুলির ভরসা ২৫০ আসনের নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার মঞ্চ। যেটি মঞ্চ নাটকের জন্য কোনও ভাবেই উপযোগী নয়। অথবা টাউনক্লাবের স্নেহময় স্মৃতি নাট্যমঞ্চ। এই মঞ্চটি চলনসই হলেও দর্শকের বসার ব্যবস্থা খোলা আকাশের নীচে। ফলে কমবেশি সাড়ে ছ’শো দর্শকের জন্য রীতিমতো প্যান্ডেল বাঁধতে হয় ডেকরেটর ডেকে। কিংবা রাধাবাজারে বিবেকানন্দ মুক্তমঞ্চ। সেখানে একটি সিমেন্টের মঞ্চ ছাড়া সবই তৈরি করে নিতে হয়। হাজারো অসুবিধা, তাই নিয়েই আগামী মরসুমের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে নবদ্বীপের আট থেকে আশির নাট্যকর্মীরা।
তাঁদের বহু দিনের দাবি একটি নাট্যমঞ্চ সমেত অত্যাধুনিক হলের প্রস্তুতি শেষের পথে। পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “নবদ্বীপের নাট্যপ্রেমীদের বহুদিনের দাবি ছিল। এর আগে মতি রায় বাঁধে টাউনহল অর্ধেক করে ফেলে রাখা হয়েছিল। আমরা টাউনহলকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। নতুন জায়গায় সম্পূর্ণ নতুন ভাবে গড়ে উঠেছে এই হল। সঙ্গে কমপ্লেক্স। পুরো ভবনটির নাম রাখা হয়েছে শ্রীচৈতন্যভবন। নাটকের মঞ্চটির নাম রাখা হয়েছে রবীন্দ্র সাংস্কৃতিক মঞ্চ। মাস তিনেকের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা রাখি।”
এক হাজার আসন বিশিষ্ট নতুন হলে কবে নাটক করতে পারবে, তার অপেক্ষায় নবদ্বীপের সমস্ত নাট্যদল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy