Advertisement
১৬ মে ২০২৪

হাজার ঝক্কি সত্ত্বেও পিকনিক, পর্যটনে ভিড়

সাগরপারের হঠাৎ হাওয়ার ইশারায় থমকে গিয়েছে পৌষালি পারদ পতন। তাপমাত্রা রাতারাতি ১০.২ ডিগ্রি থেকে প্রায় সাড়ে তিন ডিগ্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩.৮ ডিগ্রি। অন্ধ্র উপকূলে ঘনিয়ে ওঠা নিম্নচাপের ভ্রূকুটিতে দিনভর মেঘলা আকাশ। সঙ্গে কনকনে হাওয়া আর মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি। কিন্তু বছরের প্রথম দিনে এমন আবহাওয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওঁরা বলছেন, “শীত পড়ুক নাই বা পড়ুক, আজ নিউ ইয়ার।”

মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারিতে নববর্ষের ভিড়।

মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারিতে নববর্ষের ভিড়।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌতম প্রামাণিক
নবদ্বীপ ও লালবাগ শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৯
Share: Save:

সাগরপারের হঠাৎ হাওয়ার ইশারায় থমকে গিয়েছে পৌষালি পারদ পতন। তাপমাত্রা রাতারাতি ১০.২ ডিগ্রি থেকে প্রায় সাড়ে তিন ডিগ্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩.৮ ডিগ্রি। অন্ধ্র উপকূলে ঘনিয়ে ওঠা নিম্নচাপের ভ্রূকুটিতে দিনভর মেঘলা আকাশ। সঙ্গে কনকনে হাওয়া আর মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি। কিন্তু বছরের প্রথম দিনে এমন আবহাওয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওঁরা বলছেন, “শীত পড়ুক নাই বা পড়ুক, আজ নিউ ইয়ার।”

সেই মাঝ ডিসেম্বরে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল ওঁদের বেরিয়ে পড়া। ২৫ ডিসেম্বর সেটা জনসমুদ্রের চেহারা নিয়েছিল। পুরনো বছর ফুরিয়ে নতুন বছরে এসেও সেই জনসমুদ্রের ঢেউ ভাসিয়ে দিচ্ছে কখনও নবদ্বীপ, মায়াপুরের কোনও মন্দিরের চাতাল, মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি, বেথুয়াডহরির সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কখনও আবার লালবাগ, মতিঝিল কিংবা কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি, ক্যাথিড্রাল চার্চের প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সর্বত্র প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করছেন সেই সব জায়গায়। আর সেই সঙ্গে পিকনিক তো আছেই।

তবে বেড়ানো হোক কিংবা পিকনিক, পেটপুজোর বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয় সমান গুরুত্ব দিয়ে। তাই বেড়ানোর জায়গা কিংবা পিকনিক স্পট বাছাইয়ের মতো প্রাতরাশ থেকে মধ্যহ্নভোজন, বিকেলের টিফিন থেকে রাতের খাবার, সবকিছুই প্রস্তুত রাখতে হয়েছে। কড়াইশুঁটি দিয়ে মাখা ঘরে-ভাজা মুড়ির সঙ্গে গরম গরম বেগুনি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ সহযোগে সকালের টিফিন। বেলার দিকে প্যাটি আর কফি। দুপুরে ভাতের সঙ্গে ভেজ ডাল, চিপস, একটা সব্জি, খাসির মাংস, চাটনি। শেষ পাতে ফের নলেন গুড়ের সন্দেশ। এই ছিল বছরের প্রথম দিনে সাগরপাড়ার কৃষ্ণা লাহিড়ীর পারিবারিক পিকনিকের মেনু।

মতিঝিল পার্কে সপরিবার পিকনিক করতে এসেছিলেন মধ্য তিরিশের কৃষ্ণাদেবী। তিনি বলেন, “পরিবারের সবাই মিলে এসেছি। বছরের প্রথম দিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, সারাটা বছর যেন এ ভাবে হাসি-আনন্দে কাটুক।” তবে হঠাৎ করে শীতের দাপট কমে যাওয়ায় বেলার দিকে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন পর্যটকেরা। সামান্য একটু রোদ উঠতেই গায়ে গরম পোশাক রাখা যাচ্ছিল না। সেই শিলং থেকে সপরিবার নবদ্বীপ মায়াপুর বেড়াতে এসে জয়দীপ স্বর্ণকার বলেন, ‘‘এ যে দেখছি, আমাদের ওখানকার মতোই অবস্থা। মেঘলা শীতকাল ভাল লাগে না। ভাবলাম কড়া শীতের সঙ্গে চড়া রোদ থাকবে। তবে না মজা! কিন্তু সে আর হল কই!”

আসলে বছরের শেষ দিন থেকে নিম্নচাপের কল্যাণে হঠাৎ বদলে গিয়েছে আবহাওয়া। বছরের শেষ শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ছিল এখনও পর্যন্ত এ মরসুমের শীতলতম দিন। নদিয়ায় তাপমাত্রার পারদ নেমেছিল ৭.৪ ডিগ্রিতে। আর রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর তাপমাত্রা ছিল ৭.৭ ডিগ্রি। সেই তাপমাত্রা বছরের প্রথম দিন পৌঁছে গিয়েছে ১৩.৮ ডিগ্রিতে।

বর্ষার মাস দু’য়েক বাদ দিলে এখন প্রায় সারা বছরই পর্যটনের মরসুম। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এবং বিদেশি পর্যটকের ভিড় থাকে গঙ্গার পশ্চিম তীরের প্রাচীন শহর নবদ্বীপ এবং পূর্ব পাড়ের মায়াপুরে। তবে বছরের শেষ সপ্তাহে ভিড়টা কার্যত বেসামাল করে দেয় প্রশাসন থেকে মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ সকলকেই। বহিরাগত মানুষ এবং গাড়ির ভিড়ে কার্যত দিশেহারা মায়াপুর-নবদ্বীপ। বছরের শেষ সপ্তাহে ভিড়ের মুখ্য গন্তব্য অবশ্যই মায়াপুরের ইস্কন মন্দির। বছর শেষে বা নতুন বছরে বাড়ির সকলকে নিয়ে একদিন-একরাত মায়াপুরে কাটিয়ে নবদ্বীপ ছুঁয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন বহু মানুষ। রাত যদি কোনও কারণে কাটানো সম্ভব না-ও হয়, নিদেনপক্ষে একটা গোটা দিন বেড়ানোর জন্য কম খরচে মায়াপুরের কোনও বিকল্প এ তল্লাটে নেই।

তবে এ মরসুমের সব থেকে বেশি ভিড় ছিল বছরের শেষ রবিবার। ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলেন, “২৫ ডিসেম্বর নয়, রবিবার ২৮ তারিখ সব থেকে বেশি ভিড় হয়েছিল। ওই দিন ৮২ হাজারের বেশি মানুষ এসেছিলেন। পয়লা জানুয়ারি সপ্তাহের মাঝখানে পড়ায় তত ভিড় হয়নি। সংখ্যাটা ৬০ হাজারের মধ্যে ছিল।” তবে কোথাও কোনও ঘর ফাঁকা নেই। ইস্কনে সব মিলিয়ে হাজার চারেক লোকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। রমেশ দাস বলেন, “একশো টাকার গৌরাঙ্গ কুটির থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ঘর রয়েছে আমাদের। কিন্তু দুর্গা পুজোর পর থেকেই ঘরের বুকিং শেষ হয়ে যায়। তাই চাহিদার এই চূড়ান্ত সময়ে যত মানুষকে ঘর দিতে পারি, তার থেকে অনেক বেশি মানুষকে ফেরাতে বাধ্য হই। তবে যে ভাবে প্রতি বছর মানুষের ভিড় বাড়ছে, তাতে বিশ হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা করলেও সকলে জায়গা পাবেন না।”

ছুটির মরসুমের এই ভিড়ের চাপ প্রসঙ্গে নবদ্বীপ, মায়াপুর, লালবাগ বা হাজারদুয়ারির স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বক্তব্য প্রায় একই রকম। তাঁরা জানান, এই সময়টা তাঁদের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মরসুম। তবে এ বার এই প্রথম নয়, প্রতিবারই বছরের এই সময়টাই ভিড় উপচে পড়ে। মানুষ আগের থাকে অনেক বেশি করে এই দিনগুলিতে বেরিয়ে পড়ছেন। ঘরের চাহিদা যে ভাবে বাড়ছে সে ভাবে থাকার জায়গা বাড়ছে না। যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। যার নিট ফল ৩০০ বা ৪০০ টাকার ঘর হাজার টাকাতেও সময় বিশেষে মিলছে না।

সমস্যা আরও রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের শিলদা থেকে দল বেঁধে হাজারদুয়ারি বেড়াতে এসেছিলেন পিন্টু সাহা। পেশায় কৃষিজীবী পিন্টুবাবু বলেন, “এখানে সবচেয়ে অভাব শৌচাগারের। হাজার হাজার পর্যটক এই সময় বেড়াতে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে শৌচাগার না থাকায় খুবই সমস্যায় পড়তে হয়।” যদিও সল্টলেক থেকে হাজারদুয়ারিতে আসা গৌতম বিশ্বাস অবশ্য বেজায় খুশি। তিনি বলেন, “আগে একবার একা এসেছিলাম। এ বার বাড়ির সকলকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এসে দেখছি আগের থেকে লোকসংখ্যা যেন দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি টাঙা চড়ে।”

এই ছুটির সময়ে নবদ্বীপ-মায়াপুরে গাড়ির ভিড় সামাল দিতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় পুলিশ প্রশাসনের। পার্কিং-এর জায়গা ভর্তি হয়ে গঙ্গার পাড়ে গাড়ি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন বহিরাগতরা। ইস্কনের ভিতরে এক হাজার গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু সেখানেও এত গাড়ি রাখা যাচ্ছে না। একই ছবি নবদ্বীপ শহরেরও। মানুষে-গাড়িতে দমবন্ধ হয়ে বছরের শেষ থেকে হাঁসফাঁস করছে নবদ্বীপ-মায়াপুর।

শুধু ভিড় নয়, শীত উৎসবের এই মরসুমে পিকনিক ঘিরেও সমস্যা অনেক। দৈত্যাকার ডিজে বক্সের দাপট যার মধ্যে অন্যতম। আছে বিপজ্জনক ভাবে গঙ্গা ও জলঙ্গির বুকে নৌকায় পিকনিক। সঙ্গে উদ্দাম নাচ। নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশের ব্যবস্থা করেছি। শহরে সর্বক্ষণ চলছে পুলিশি টহল। রাত এগারোটার পরে মাইকের শব্দ পেলেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নবদ্বীপের খেয়াঘাট থেকে পিকনিকে নৌকা ভাড়া দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। কোথাও যাতে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে দিকে আমরা কড়া নজর রাখছি।”

তবে যাঁদের জন্য এত ব্যবস্থা, তাঁরা অবশ্য এত কিছু ভাবতে রাজি নন। বছরের প্রথম দিনটি ‘সেলিব্রেট’ করতে দিনভর মাঝনদীতে চলল উদ্দাম নাচ-গান। খেয়াঘাট থেকে নৌকা না দিলেও অন্যত্র থেকে নৌকার ব্যবস্থা করেছেন অনেকেই।


বৃহস্পতিবার গৌতম প্রামাণিক ও সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

picnic new year celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE