Advertisement
E-Paper

পুলিশ-দখলে ভাঙড়, জালে নকশাল নেত্রী

সূর্য ডুবতেই মাছিভাঙা গ্রাম থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছিল একটি মোটরবাইক। পিছনে টপ এবং জিনস পরিহিত এক মহিলা। তাঁর মুখ ঢাকা শালে। কিন্তু সিআইডি-র নজর এড়ানো গেল না!

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৩
ধৃত নকশাল নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরী।

ধৃত নকশাল নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরী।

সূর্য ডুবতেই মাছিভাঙা গ্রাম থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছিল একটি মোটরবাইক। পিছনে টপ এবং জিনস পরিহিত এক মহিলা। তাঁর মুখ ঢাকা শালে। কিন্তু সিআইডি-র নজর এড়ানো গেল না!

এত দিনের ‘মুক্তাঞ্চল’ ভাঙড়কে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে দিন ‘ছন্দে’ ফেরানোর কাজ শুরু হল, সেই বুধবারই সন্ধ্যায় পানাপুকুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হলো নকশাল সংগঠন সিপিআই (এমএল) রেড স্টারের নেত্রী শর্মিষ্ঠা চৌধুরীকে। তাঁর বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি পুলিশের উপরে হামলা, উস্কানি, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর-সহ বেশ কিছু ধারায় অন্তত সাতটি মামলা দায়ের হয়েছে। একই অভিযোগে অভিযুক্ত শর্মিষ্ঠার স্বামী অলীকও। এ দিন রাত পর্যন্ত তাঁকে অবশ্য ধরা যায়নি। শর্মিষ্ঠার গ্রেফতারির পরে ফের গ্রিড সংলগ্ন কয়েকটি রাস্তা অবরোধ করা হয়।

পুলিশ সূত্রে খবর, ফের অশান্তির আশঙ্কায় এ দিন সকাল থেকেই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয় ‘আন্দোলনের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত খামারআইট, মাছিভাঙা, বকডোবা, টোনা, উড়িয়াপাড়া-সহ ছ’সাতটি গ্রামে। তবে কোনও অশান্তি হয়নি। দোকানপাট চালু হয়েছে। যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু করে বাসও। পাওয়ার গ্রিডের নির্মীয়মাণ সাব-স্টেশনের সামনে ফের পুলিশ প্রহরা বসে। সচল হয় পুলিশ ফাঁড়ি।

বিনা প্রতিরোধে পুলিশ-প্রশাসন যখন ‘কাজ’ শেষ করছে, তখনই শর্মিষ্ঠা মাছিভাঙা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। গ্রামের রাস্তা ধরে মোটরবাইকটি যখন পানাপুকুর এলাকায় পৌঁছয়, সেখানে ওৎ পেতে ছিল সিআইডি-র একটি দল। তারা বাইকটি থামায়। ধরা পড়ে যান শর্মিষ্ঠা। তাঁকে নিউটাউন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

এ দিন দুপুরেই ভাঙড়-কাণ্ডের তদন্তভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেয় রাজ্য সরকার। রাতে এডিজি সিআইডি রাজেশ কুমার বলেন, ‘‘শর্মিষ্ঠাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ওই মোটরবাইক-চালককে। ভাঙড়-কাণ্ডে বাকি অভিযুক্তদেরও শীঘ্রই ধরা হবে।’’

সাব স্টেশনের বাইরে পুলিশবাহিনী।ছবি: সামসুল হুদা।

পাওয়ার গ্রিডের সাব-স্টেশন নির্মাণকে কেন্দ্র করে গত ১৭ জানুয়ারি আগুন জ্বলেছিল ভাঙড়ের পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েত এলাকায়। পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। গুলিতে মৃত্যু হয় দুই যুবকের। জখম হন অনেক পুলিশকর্মী। পুলিশের বহু গাড়ি ভাঙচুর করে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। গাছের গুঁড়ি ফেলে, অস্থায়ী ইটের পাঁচিল বানিয়ে রাস্তা অবরোধ করা হয়। তার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত পুলিশ গ্রামে ঢুকতে পারেনি।

ভাঙড়ের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে নানা মহলে জল্পনা যখন তুঙ্গে, তখন মঙ্গলবার বিকেলই কিছুটা ‘আলো’ দেখিয়েছিলেন রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। তাঁর নেতৃত্বে পোলেরহাট, খামারআইট, টোনা, মাছিভাঙা, শ্যামনগরের মতো গ্রামগুলি থেকে অবরোধ হটিয়ে দেওয়া হয়। সব্যসাচীবাবু যেখানে শেষ করেছিলেন, বুধবার যেন সেখান থেকেই শুরু করে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ-প্রশাসন।

এ দিন সকাল ন’টা নাগাদ গ্রিড সংলগ্ন শ্যামনগর গ্রামের দিক থেকে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের নবম ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডান্ট কঙ্করপ্রসাদ বারুইয়ের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী ‘রুটমার্চ’ শুরু করে। একই ভাবে বাহিনী নিয়ে বকডোবা গ্রামের দিক থেকে এগোন পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী। গ্রামগুলিতে পুলিশ ছড়িয়ে পড়ে। শান্তি বজায় রাখতে মাইকে আবেদন জানানো হয়। আগের রাতে মাছিভাঙা গ্রামে আন্দোলনকারীদের কাটা একটি রাস্তা ভরাট করে দেওয়া হয়। পুকুর থেকে পুলিশ ভ্যান, রাস্তা থেকে আধপোড়া গাড়িও সরিয়ে ফেলা হয়। ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ বলেন, ‘‘ভাঙড়ে যাঁরা রাস্তা কেটেছিলেন, তাঁরাই আবার রাস্তা ঠিক করে দিচ্ছেন। গ্রামবাসীদের নিজেদের কোনও সমস্যা নেই। ওঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু হবে না। ওঁদের ভুল বোঝানো হয়েছিল। সেই অবস্থাটা কেটে গিয়েছে।’’

এত দিন গ্রামে আন্দোলনকারী হিসেবে যাঁরা পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, এ দিন তাঁদের দেখা মেলেনি। পুলিশ ঢোকার পরে দেখা যায়, রাস্তাঘাট সুনসান। শুধু মোড়ে মোড়ে মহিলাদের জটলা। তাঁরা দাবি করতে থাকেন, ‘‘নকশাল নেতারা মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন।’’ কিন্তু শর্মিষ্ঠা গ্রেফতারের পরে সিআইডি-র দাবি, মাছিভাঙা গ্রামেই কিছু নকশাল নেতা লুকিয়ে রয়েছেন মঙ্গলবার থেকে। তাঁরা গোপনে বৈঠকও করছেন।

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, গ্রামগুলিকে ঘিরে একটি সুরক্ষা-বলয় তৈরি করা হয়েছে। গ্রাম থেকে কেউ বাইরে বেরোলে বা বাইরের কেউ এলে পুলিশের নজরবন্দি হয়ে যাবেন। সেই বলয়েই শর্মিষ্ঠা আটকে গিয়েছেন বলে পুলিশের কেউ কেউ মনে করছেন। প্রশাসনের একটি সূত্রের মতে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল, যাতে শর্মিষ্ঠা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কৌশল নেওয়া হচ্ছে বলে প্রশাসনের ওই সূত্রটির দাবি। শর্মিষ্ঠাকে গ্রেফতার নিয়ে তাঁর দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শঙ্কর দাস বলেন, ‘‘গ্রেফতারের প্রতিবাদ করছি। এই ঘটনায় প্রমাণ হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনায় বিশ্বাসী নন। ভাঙড়কে তিনি দ্বিতীয় নন্দীগ্রাম বানাতে চাইছেন!’’

শর্মিষ্ঠা গ্রেফতারের পরে উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীরাও। খামারআইটের এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘রাতে আর বাড়িতে থাকা যাবে না। এখন তো পুলিশ বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করবে।’’ বকডোবা গ্রামের এক মহিলা বলেন, ‘‘সবাই তো আর আন্দোলন করেননি। কিন্তু পুলিশ কাউকে ছাড় দেবে না বলে মনে হয়।’’

পুলিশি অভিযানের সমালোচনা করেছে বাম এবং কংগ্রেসও। বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘গ্রামবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই গ্রেফতারে প্রমাণ হল, পুলিশ-প্রশাসন জমি মাফিয়াদেরই পাশে আছে! পুলিশ ধরলে প্রতিবাদকারীদেরই ধরবে!’’ একই সুরে বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘জমি মাফিয়ারা ভাঙড়ে যে ভাবে গরিব মানুষ ও বর্গাদারদের জমি কেড়ে নিল, তার কোনও বিচার মুখ্যমন্ত্রী করলেন না! প্রতিবাদের কারণ ছেড়ে প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করে এই সরকার প্রমাণ করছে, তারা জমি-মাফিয়াদের পক্ষে।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই সরকার বিরোধীদের কথা বলতে দেয় না। আন্দোলনকারীরা আলোচনা চেয়েছিল, সরকার সে দিকে হাঁটল না।’’

শর্মিষ্ঠা গ্রেফতার হওয়ার পরে পুলিশ কিছুটা স্বস্তি পেলেও তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা। গত ১৭ জানুয়ারি ভাঙড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে মামলাটি করেন নিহত মফিজুল আলি খানের বাবা সুকুর আলি খান এবং দাদা এমতাজুল আলি।

এমতাজুলদের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু সিংহ রায় জানান, মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, সে দিন ভাঙড়ে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষের সময়ে পুলিশের গুলিতে মফিজুলের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই দিন আর এক যুবকও (আলমগির মোল্লা) গুলিতে মারা যান। নিরীহ দুই যুবক কী ভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন, তার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যে হেতু পুলিশই ঘটনায় অভিযুক্ত, তাই রাজ্য সরকারের অধীনস্থ কোনও সংস্থা নয়, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কোনও সংস্থা তদন্ত করুক।

এ দিন আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে সুকুর আলি জানান, পুলিশ সত্য ধামাচাপা দিতে চাইছে। সেটা ঠেকাতেই তাঁরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। সুকুরের অভিযোগ, গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আলমগিরের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা দিয়ে পুলিশ মুখ বন্ধ করতে চাইছে। পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের চাপে তিনি পরিবার নিয়ে এলাকার বাইরে রয়েছেন বলেও এ দিন দাবি করেন সুকুর। সেই কারণে মামলার আবেদনে নিরাপত্তার দাবিও জানিয়েছেন তিনি।

Arrest Naxalites violence Sarmistha Chowdhury
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy