বিশাল এ বিশ্ব। তার কোন আনাচে–কানাচে রক্ত সম্পর্কের কোন জ্ঞাতি লুকিয়ে আছে, কে বলতে পারে?
শুধু মানুষ নয়। তামাম প্রাণিজগতেই ব্যাপারটা সত্যি। বাঙালির সাধের বোরোলি মাছের কথাই ধরা যাক। তিস্তা-তোর্সার বোরোলির চিরন্তন আস্বাদে বাঙালির জিভ মজে রয়েছে বহু দিন ধরে। এ বার তার এক অচেনা জ্ঞাতির দেখা মিলল উত্তরবঙ্গের নদীতে। ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ (জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে জেডএসআই) সূত্রের খবর, এর সন্ধান আগে পাওয়া গিয়েছিল কেরলের পশ্চিমঘাট তল্লাটে। বঙ্গভূমে তার উপস্থিতির সংবাদ এত দিন জানা ছিল না।
একই ভাবে এ রাজ্যে সামুদ্রিক বানমাছের (ইল) আর এক জ্ঞাতির খোঁজ মিলেছে। বছরখানেক আগে শঙ্করপুরের সমুদ্রে জালে ধরা পড়ে মৎস্যজীবীদের ধাঁধা লাগায় বান-গুষ্টির ওই সদস্য। ‘‘এ আবার কোন ধরনের বান?’’— অচেনা চেহারা দেখে বলাবলি করছিলেন মৎস্যজীবীরা। তাঁদের থেকে মাছটি নিয়ে আসেন জেডএসআইয়ের বিজ্ঞানী অনিল মহাপাত্র। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ যাবৎ বাংলায় পরিচিত দেড়শো প্রজাতির বানমাছের তালিকায় সেটি নেই!
অর্থাৎ এ-ও যেন লুকিয়ে থাকা আত্মীয়ের আত্মপ্রকাশ! প্রাণী-বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘জিমনোথারাক্স মিশরাই’ নামের ওই বানমাছের বাস নদী বা সমুদ্রের তলদেশে। বাদামিরঙা জলচরটি লম্বায় ৩২.৪ সেন্টিমিটার। মানুষের খাদ্যতালিকাতেও সে ঠাঁই পেতে পারে। আর বোরোলির নতুন প্রজাতির নাম দেওয়া হয়েছে বেরিলিয়াস আর্ডেনস। বেরিলিয়াস শব্দটি এসেছে বোরোলি থেকে। আর্ডেনস অর্থ শিখা। সাধারণ বোরোলির রং চকচকে রুপোলি হলেও আর্ডেনসের গায়ে রঙিন দাগ। অনেকটা আগুনের শিখার মতোই। এদের বাস খরস্রোতা নদীতে, পাথরের খাঁজে খাঁজে। আণুবীক্ষণিক জীব খেয়ে বাঁচে। তবে তার নিজের স্বাদ চিরচেনা রুপোলি বোরোলির মতো কি না, জানা যাচ্ছে না। কারণ এমন কারও খোঁজ মেলেনি, যিনি কিনা মাছটি খেয়েছেন। সেটি আদৌ খাওয়ার যোগ্য কিনা, তাও নিশ্চিত নয়। ‘‘সাধারণ বোরোলির মতো দেখতে না-হওয়ায় স্থানীয় মানুষ ওই মাছ মুখে তোলার ঝুঁকি নেননি। আমরা যাচাই করব, সেটি খাওয়া মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর কি না।’’— বলছেন এক বিজ্ঞানী। তাঁরা আপাতত জানাচ্ছেন, ৯৫-১০৫ মিলিমিটার লম্বা মাছগুলো অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখার পক্ষে আদর্শ।
জেডএসআইয়ের অধিকর্তা কৈলাস চন্দ্রের দাবি, এক বছরে রাজ্যের নানা প্রান্তে বিভিন্ন প্রাণীর এমন ২৬টি নয়া প্রজাতির সন্ধান মিলেছে। মাছেরই ছ’টি।
মাকড়সা-বোলতার মতো কীটপতঙ্গ, ফিতাকৃমির মতো পরজীবীর অচেনা জ্ঞাতিগুষ্টিরও দেখা মিলেছে। গত এক শতকে বিভিন্ন প্রাণীর অন্তত ১১ হাজার প্রজাতির হদিস দিয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যেই কেন এত?
নেপথ্যে ভৌগোলিক অবস্থানের ভূমিকা দেখছেন প্রাণী-বিজ্ঞানীরা। ওঁদের ব্যাখ্যা: পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে খাড়া হিমালয় পর্বত, যা কার্যত জীব-বৈচিত্রের খনি (বায়োলজিক্যাল হটস্পট)। দক্ষিণে সমুদ্র ও খাঁড়ির পাশাপাশি হরেক কিসিমের জীবজন্তু, পোকা-মাকড়ে ভরপুর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। গঙ্গা-দামোদরের মতো নদীগুলি নানা রকমের মাছ ও জলজ প্রাণীর আঁতুড়। আবার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের রুক্ষ মালভূমিও আছে। এ হেন ভৌগোলিক বৈচিত্রের সুবাদে এ রাজ্যে জীববৈচিত্রের বাহারও বেশি।
‘‘তাই পশ্চিমবঙ্গ দেশের জীব-বৈচিত্রের রাজধানী।’’— মন্তব্য জে়এসআইয়ের অধিকর্তা কে বেঙ্কটরমনের।
নিত্য নতুন প্রজাতি আবিষ্কারের তাৎপর্য কী?
প্রাণী-বিজ্ঞানীদেরা বলছেন, তাৎপর্য প্রভূত। এদের অস্তিত্ব এত দিন অজানা থাকায় পরিবেশে তাদের গুরুত্বও জানা নেই। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট প্রজাতিরা পরিবেশ এবং বাস্তুতান্ত্রিক গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদ (বায়োডায়ভার্সিটি বোর্ড)-এর চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যালের কথায়, ‘‘বাস্তুতন্ত্রে প্রাণীগুলির প্রভাব খতিয়ে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা যাচাইও জরুরি। প্রয়োজনে সংরক্ষণের আওতায় আনতে হবে।’’
আছে উদ্বেগের ছোঁয়াও। জীববৈচিত্রের উপরে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু বদলের কুপ্রভাব নিয়ে প্রাণী সর্বেক্ষণের কর্তারা বিলক্ষণ চিন্তিত। এ বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রাথমিক ভাবে হিমালয় অঞ্চলকে বাছা হয়েছে। দেখা হবে, আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কোনও প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেল কি না। কিংবা অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে কোনও প্রজাতি অন্য জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে কি না।
মাছ-মাকড়সার বংশলতিকায় যোগ-বিয়োগের ছবিটা তখনই পরিষ্কার হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy