সল্টলেকের সিন্ডিকেট থেকে মালদহের কালিয়াচকে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য—এমন অনেক ব্যাপারেই কঠোর পদক্ষেপে বদ্ধপরিকর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই নির্দেশ পেয়েই ১০০ জন বাছাই অফিসারকে নিয়ে স্পেশাল টিম গড়ে অভিযানে নেমেছে মালদহ জেলা পুলিশ। তাতে ভিন জেলার অনেক পুলিশ অফিসারকেও সামিল করা হয়েছে। এতেই দাগি অপরাধীরা ধরা পড়তে শুরু করেছে। প্রথমে ধরা হয়েছে নওদা যদুপুরের ত্রাস বকুল শেখকে। তার পরপরই পুলিশের কব্জায় এসেছে জাকির শেখও।
পুলিশি তৎপরতায় ঘাবড়ে গিয়েই দুষ্কৃতীরা ধরা দিচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীদের অনেকেই। অন্তত, আইনজীবীর সঙ্গে থানায় গিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য ফেরার আসামি জাকির শেখ অনুনয় করেছে বলে খবর চাউর হতে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে বাসিন্দাদের কাছেও। সে জন্যই এলাকায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরাতে ধৃতদের সব শাগরেদকে গ্রেফতারের দাবিতে সরব হয়েছেন বাসিন্দারা।
মালদহের পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ পুলিশের এডিজি নটরাজন রমেশবাবুর নির্দেশে বিশেষ দল গঠন করে এক মাস আগে থেকেই অভিযান শুরু করা হয়েছে। কুখ্যাত দুই দুষ্কৃতী বকুল ও জাকির গ্রেফতার হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।’’ পুলিশ সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গের এডিজি এন রমেশবাবু বারবার মালদহে গিয়ে ঘাঁটি গেড়ে অভিযানের ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাতেই কাজটা মসৃণ হয়েছে বলে পুলিশের একাংশের দাবি।
বস্তুত, অনেক দিন ধরেই নওদা যদুপুর, ভাগলপুর, জালালপুর থেকে শুরু করে কালিয়াচকের একটা বিস্তীর্ণ এলাকা খুন-জখম, বোমাবাজি, গুলির লড়াইয়ে উত্তপ্ত ছিল। সীমান্তে নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম ছাড়াও গ্রাম পঞ্চায়েত ও এলাকায় কর্তৃত্বের রাশ নিজেদের দখলে রাখা নিয়ে গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এখানে বকুল শেখ ও জাকির শেখের গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই চলেছে বলে পুলিশের দাবি। দু’পক্ষের বেশ কয়েকজন যেমন খুন হয়েছেন। তেমনই গুলি ও বোমাবাজির লড়াইয়ের সামনে পড়ে কয়েকজন নিরীহ মানুষেরও প্রাণ গিয়েছে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর গুলি-বোমার লড়াই চলায় বারবারই স্তব্ধ হয়েছে সেটি। তোলাবাজি ও ছিনতাইয়েরও দাপট থাকায় ব্যবসায়ীরাও শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছিলেন না। নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশের একাংশ হাত গুটিয়ে বসেছিলেন বলে অভিযোগ। পক্ষান্তরে, পুলিশের প্রচুর গাড়ি ভাঙচুরও হয়েছে। পুলিশও আক্রান্ত হয়েছে। বিরোধীরা তো বটেই, স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে এলাকায় শান্তি ফেরাবার লক্ষ্যে গঠিত নাগরিক কমিটিও পুলিশের ওই ভূমিকা নিয়ে বারবার সোচ্চার হয়েছিল।
এই অবস্থায়, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তায় কালিয়াচকের ওই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে মালদহ জেলা তো বটে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার অন্তত ১০০ জন পুলিশ অফিসার-কর্মীদের নিয়ে বিশেষ দল গঠন করা হয়। স্পেশাল গ্রুপও গঠন করা হয়. তারাই বকুলকে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করে। এলাকায় পুলিশ এমন চাপ তৈরি করে যে জাকির আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
তাই দাঁড়িয়াপুর বাইশি নাগরিক কমিটির সম্পাদক ইদ্রিশ আলি বলেন, ‘‘এলাকায় গুন্ডারাজ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরা প্রথম থেকেই পুলিশি হস্তক্ষেপ চেয়েছি। কিন্তু পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের বিস্মিত করেছিল। লাগাতার গুলি-বোমার লড়াইয়ে মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ দুই ত্রাসকে গ্রেফতার করেছে। বাকি যারা রয়েছে, তাদেরও গ্রেফতার করতে হবে।’’
কালিয়াচক ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, কয়েক বছর ধরে গুলি-বোমার লড়াই চলায় কালিয়াচকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছিল। ব্যবসায়ীরা মহাজনদের টাকা শোধ পর্যন্ত করতে পারতেন না। মালদহ মার্চেন্টস চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘‘এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, ওই এলাকার দুষ্কৃতীরা বিভিন্ন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় এতদিন কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করেনি। আমরা মনে করি মুখ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগে প্রশাসনকে কড়া হওয়ার যে বার্তা দিয়েছেন, তার ফলে পুলিশের এই সক্রিয়তা. ব্যবসায়ীরা শান্তিতে যাতে ব্যবসা করতে পারে এটা পুলিশ যেন নিশ্চিত করে।’’