জলপাইগুড়ি রাস্তা আটকে চলছে বাজি পোড়ানো। ছবি: সন্দীপ পাল।
সন্ধে ৬টা-৮টা: ঠাস-ঠাস দ্রুম দ্রাম
শিলিগুড়িতে শুরুটা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ ভাবেই। দিনের আলো সবে নিভেছে। বাড়ি-দোকান-রাস্তায় আলোর মালা ঝুলঝে। নানা রঙের তারাবাতি-ফুলঝুরি হাতে কচিকাচাদের ছোটাছুটি। মাঝেমধ্যে অবশ্য কালিপটকা, ঢিলবোমের শব্দ শোনা গিয়েছে। জলপাইগুড়ির বেশ কিছু মণ্ডপে এ দিন দেবী প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শহরে সন্ধে নেমেছিল ঢাকের শব্দেও। যদিও, সময় এগোতেই শুরু হাউই বাজির দাপট। নিষিদ্ধ না হলেও যে সব আতসবাজি ওপরে গিয়ে নানা বিচ্ছুরণে এবং বেশ শব্দ করে ফেটে যায়, সেগুলিতেও কানে তালা লাগার জোগাড় বাসিন্দাদের, অভিযোগ বাসিন্দাদের। শব্দবাজি নিষিদ্ধ হওয়ায় বাজি প্রস্তুতকারীরা আতসবাজির শব্দের মাত্রাই বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। যে কোনও বাজির শব্দের মাত্রা যাচাইয়ে ব্যবস্থা থাকে। যদিও জেলাগুলিতে সে ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
জলপাইগুড়ির এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘শুধু আমাদের জেলায় কেন, উত্তরবঙ্গের কোথাও সেই ব্যবস্থা নেই। তাই আতসবাজির মোড়কে শব্দবাজি বিক্রি হলেও আমাদের কিছু করার নেই।’’ আলিপুরদুয়ারে অবশ্য বিকেল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে শব্দবাজির তাণ্ডব। সে শব্দ নিষিদ্ধ বাজির, নাকি আতসবাজির, সেটা দেখার কোনও ব্যবস্থাই নেই। তবে মোটের ওপর উত্তরবঙ্গের কমবেশি সব এলাকাতেই সন্ধে ৬টা থেকে সাতটা এক ঘণ্টা শব্দবাজি পুড়েছে তুলনামূলক কম।
নিষিদ্ধ বাজির অভিযোগ: কোথাও দোদোমা, কোথাও চকলেট বোমা। আলিপুরদুয়ার শহরে রেল জংশনে পুড়ল দেদার বাজি।
• শিলিগুড়ির মাল্লাগুড়ি, চম্পাসারিতে নিষিদ্ধ বাজি পুড়ল প্রকাশ্যেই।
• জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাতকাটা-অরবিন্দনগরে শব্দবাজি পুড়লেও পুলিশ পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ।
• সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রায়গঞ্জের মিলনপাড়া, উকিলপাড়া, মোহনবাটি, সুদর্শনপুর, এমজি রোড, বিদ্রোহী মোড়, শিলিগুড়ি মোড়ে শব্দবাজি ফাটতে দেখা গিয়েছে।
• দিনহাটা, তুফানগঞ্জেও শব্দবাজি পোড়ানোর অভিযোগ মিলেছে।
পুলিশ উবাচ
রাত ৮টা-১০টা: বাজি না বোমা!
বিদ্যুতের চমক দেখে অনেকে যেমন কানে আঙুল চাপা দেন, তেমনিই আকাশে আলোর রোশনাই দেখলেই আঁতকে ওঠে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীটি। কোচবিহারের নিউটাউন এলাকা দিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গেও এগোতে চাইছিল না সে। মুহুর্মুহু শব্দবাজি এবং চড়া শব্দের আতসবাজি ফাটছে। ক্ষুব্ধ ছাত্রীর বাবা তথা স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘‘আইন রয়েছে, সেই আইন যাতে মেনে চলা হয়, সে জন্য পুলিশও রয়েছে। তবে মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। সে জন্যই আজ এমন পরিস্থিতি।’’
শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড এবং সেবক রোডে প্রকাশ্যেই বাজি পুড়তে দেখা গিয়েছে। হাকিমপাড়া, আশ্রমপাড়ার কয়েকটি পুজো মণ্ডপের আশেপাশে দেদার শব্দবাজি ফেটেছে। আলিপুরদুয়ারে অবশ্য রেল জংশন এলাকায় নিষিদ্ধ চকলেট বোম রাস্তায় ছুড়ে ফাটানোর অভিযোগ উঠেছে। বাসিন্দাদের একাংশ অভিয়োগ জানালেও পুলিশ ভ্যান আসার আগেই বাজি পোড়ানোর দল পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। মালদহের ইংরেজবাজারের বিএস রোডে কয়েক জন যুবক গোল করে চকলেট বোমা ফাটাচ্ছে বলে অভিযোগ। পাশ দিয়ে দেখা গেল উর্দিধারীদেরও হেঁটে যেতে। বাজির শব্দ শুনে তাঁদের কেউ কেউ কানে হাত দিলেও বাজি যাঁরা পোড়াচ্ছিলেন, তাঁদের দিকেও ফিরেও তাকাননি বলে অভিযোগ। ইংরেজবাজারের তিরোজপুরে থানা থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে রাস্তা আটকে শব্দবাজি ফাটাতে দেখা গেল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। সেই দলে ছিলেন মহিলারাও। এই দুই ঘণ্টায় উত্তরবঙ্গের সর্বত্র দেদার শব্দবাজি পুড়েছে বলে অভিযোগ।
নিষিদ্ধ বাজির অভিযোগ: আলিপুরদুয়ার শহর ও আলিপুরদুয়ার জংশন রেল কলোনির অলিগলিতে পথচারীদের তোয়াক্কা না করে দেদার ফাটলো চকলেট বোম।
• দিনহাটা মেন রোডে শব্দবাজির দাপটে বিরক্ত বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতারা। পুলিশে অভিযোগ জানানো হলে টহলদারি ভ্যান আসার আগেই বাজি পোড়ানো বন্ধ।
• শিলিগুড়ির বর্ধমান রোডে বিভিন্ন ক্লাব এবং পুজো কমিটি দেদার বাজি পোড়াল বলে অভিযোগ। বাজি পুড়ল বাবুপাড়া, হাকিমপাড়া, প্রধাননগরেও।
• ময়নাগুড়ি বাজার, চৌপথী এলাকায় পুলিশি টহলদারি ভ্যানের সামনেই পুড়ল বাজি।
• জলপাইগুড়িতে থানা থেকে কয়েক পা এগোলেই দেদার বাজির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। দিনবাজার, কদমতলা এলাকাতেও মুহুর্মুহু শব্দবাজি পুড়েছে।
• রায়গঞ্জের মিলনপাড়া, উকিলপাড়া, মোহনবাটি, সুদর্শনপুর, এমজি রোড, থানারোড, বিদ্রোহীমোড়ে শব্দবাজির মুক্তাঞ্চল।
রাত ১০টা-১২টা: পুলিশ কোথায়?
সন্ধে নাগাদ বেশ কিছু এলাকায় পুলিশের টহলদারি ভ্যান দেখা গিয়েছিল। রাত দশটার পরে ভ্যানের টহল বন্ধ হয়ে যায় বলে অভিযোগ। কোনও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ভ্যানকে। রায়গঞ্জ, ইসলামপুর, চাঁচল, হরিশ্চন্দ্রপুর, মালদহ, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি সর্বত্রই এই অভিযোগ। রাত দশটার পরে মাইক বাজানোও নিষিদ্ধ। কিন্তু মধ্যরাত পর্যন্ত শব্দ তাণ্ডব চলেছে কোচবিহার শহরে।
কোচবিহার নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি রাজু রায় বলেন, “শব্দবাজি বন্ধে পুলিশের আরও কড়া নজরদারির দরকার ছিল।” দিনহাটা নাগরিক মঞ্চের সম্পাদক জয়গোপাল ভৌমিক বলেন, “রাত যত বেড়েছে শব্দবাজির তাণ্ডবও যেন বেড়েই গিয়েছে।’’ গত কয়েক দিন ধরেই জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের দাবি, নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি রুখতে নজরদারি রয়েছে। যদিও, এ দিন শব্দ তাণ্ডবে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা পুলিশের সেই দাবি মানতে চাননি। ঘড়ির কাটা সন্ধ্যা পৌনে বারোটায়৷
জলপাইগুড়ি শহরের পাণ্ডাপাড়া লেন ধরে পুজো দিয়ে মণ্ডপ থেকে রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছিলেন এক দম্পতি৷ আচমকাই আগুনের ফুলকি দেখে চালক রিকশায় ব্রেক কষলেন৷ রিকশা থেকে খানিকটা দূরে ফাটলো চকলেট বোমাটি৷ দম্পতির তখন কানে আঙুল৷ পাশ থেকে এক যুবক রিকশাচালককে নির্দেশ দিলেন, ‘‘তাকাবি না! রাস্তার ও পাশটা দিয়ে চটপট চলে যা৷ আরও বোমা ফাটবে।’’ মধ্যরাত পর্যন্ত বাজির শব্দ শোনা গিয়েছে জলপাইগুড়ির অরবিন্দনগর, শিরিষতলা এলাকা থেকেও। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর, নয়াবাজার, তপনের মতো গ্রামীণ এলাকা হোক বা বালুরঘাটের মতো শহর এলাকা — শব্দবাজির তাণ্ডবে কমতি ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy