Advertisement
E-Paper

লোভের ফাঁদে? ওঁদের না

উদয়াস্ত খেটে সংসার চালালেও রাতারাতি লাখপতি হওয়ার টোপ হেলায় উড়িয়ে দিয়ে ওঁরাই এখন ‘উত্তরের গর্ব’! সব মিলিয়ে সাত জেলায় সংখ্যাটা অন্তত ৭০ জন। বেশির বাগই প্রকাশ্যে আসতে রাজি হননি।

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০২:১০
রায়গঞ্জ মুখ্য ডাকঘরে নোট বদলের জন্য তিল ধারণের জায়গা নেই সকাল ৯টাতেই। — গৌর আচার্য

রায়গঞ্জ মুখ্য ডাকঘরে নোট বদলের জন্য তিল ধারণের জায়গা নেই সকাল ৯টাতেই। — গৌর আচার্য

উদয়াস্ত খেটে সংসার চালালেও রাতারাতি লাখপতি হওয়ার টোপ হেলায় উড়িয়ে দিয়ে ওঁরাই এখন ‘উত্তরের গর্ব’! সব মিলিয়ে সাত জেলায় সংখ্যাটা অন্তত ৭০ জন। বেশির বাগই প্রকাশ্যে আসতে রাজি হননি। কিন্তু, সাহস করে কয়েকজন খোলাখুলি স্বীকার করেছেন, তাঁদের কাছে কালো টাকা সাদা করানোর টোপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কে বা কারা দিয়েছিল তা তাঁরা কোনমতেই জানাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

ওঁদের কেউ সেলুন চালান। কারও চায়ের দোকান। কেউ চুক্তির ভিত্তিতে বিউটি পার্লার চালান। কেউ আবার সামান্য জমিতে চাষবাস করে দুবেলা স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে ঢাল-ভাত জোটাতেই হিমশিম। কেউ আবার পাহাড়ি পথের গাড়ির চালক। শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার পার্লার কর্মী থেকে মালবাজারের চা শ্রমিক, ফালাকাটার চাষি কিংবা কোচবিহারের সেলুন মালিক—নিজের অ্যাকাউন্টে রাতারাতি দু-আড়াই লাখ টাকা জমা করার টোপ ফিরিয়ে দিতে কেউ কারও চেয়ে কম যান না। কেউ সবিনয়ে ফিরিয়েছেন। কেউ নানা কায়দায় পাশ কাটিয়েছেন। কারও বক্তব্য, ‘‘সংসারে অভাব থাকতে পারে। তা বলে পরের ঝামেলা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে শর্টকাটে বড়লোক হতে চাই না। খেটে খাচ্ছি, খেটেই খাব।’’ আবার কেউ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, টাকাটা নেওয়ার পরে থানা-পুলিশ-আয়করের জেরার মুখে পডার আশঙ্কায় তাঁরা ও পথে হাঁটতে রাজি নন। কয়েকজন তো এটাও মনে করেন, যাঁরা ফাঁকতালে উপার্জন করে রাশি রাশি টাকা জমিয়েছেন, তাঁদেরই ভোগা উচিত।

উত্তরবঙ্গের নানা এলাকায় এমন লোভ-টোপ উপেক্ষার আড়ালে অবশ্য একাধিক কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, কথা সাহিত্যিকরা। যেমন, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক তথা শিলিগুড়ির শক্তিগড় এলাকার বাসিন্দা বিপুল দাসের মতে, মূলত নৈতিকতার সূক্ষ্ম সূতোর টানেই কালো টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে রাখার প্রস্তাব ওঁরা অনায়াসে উপেক্ষা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কারও জীবনযাপন যাই-ই হোক না কেন, নীতির সুতোর একটা বাঁধন কিন্তু অনেকেই মনে মনে মেনে চলেন। এখানেও মূলত সেটাই হচ্ছে। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালালেও রাতারাতি অসদুপায়ে ধনী হতে চাইছেন না তাঁরা।’’ তবে বিপুলবাবু এটাও জানান, কিছু ক্ষেত্রে অন্যের টাকা নিয়ে পরে ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কা, অসম্মানিত হওয়ার ভয়ও হয়তো কিছু ক্ষেত্রে কাজ করেছে।

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শান্তনু দে কিন্তু মনে করছেন, এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, ‘‘কেউ গরিব মানেই তাঁর মানসিকতাও গরিব সেটা ভাবাটা একেবারেই অযৌক্তিক। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি যাঁরা আত্মসম্মান খুইয়ে কখনও বেশি আয়ের পথে হাঁটবেন না। এ ক্ষেত্রেও তেমন মানসিকতা কাজ করে থাকতে পারে।’’ শান্তনুবাবুর সংযোজন, ‘‘আরও ২টো বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমত, ভারতীয় সনাতন ধর্মে ত্যাগ স্বীকার, কৃচ্ছ্রসাধন ছোট থেকেই শেখানো হয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ আইন মেনে চলার পক্ষে। এটাও তারই প্রতিফলন।’’

আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের সভাপতি ল্যারি বসু কিংবা শিলিগুড়ির নাগরিক সংগঠনের কর্তা রতন বণিকরাও শুনেছেন, গাড়ির চালক, পরিচারিকা, চৌকিদারের অ্যাকাউন্টে রেখে কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না। রতনবাবু বলেন, ‘‘অনেক বিষাদের খবরের মধ্যেও যখন নানা জনে লাখপতি হওয়ার অফিসার ফিরিয়ে দিচ্ছে শোনা যায়, তখন মনটা ভাল হয়ে যায়।’’ ল্যারিবাবু জানান, আলিপুরদুয়ারের চা বলয়ের বেশ কয়েক জন শ্রমিক ওই ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কষ্টে থাকলেও ঝঞ্ঝাটের জীবনে জড়াতে চান না।

Money Post office
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy