Advertisement
০৪ জুন ২০২৪

পার্টিগণিতেই প্রহর পার

কোথাও টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজে কান পাতা দায়। আবার কোথাও কেউ রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ছেন। ঘনঘন ধূমপান। বারবার চা। নানা অঙ্ক কষে কারও দাবি, জোট আসছে ক্ষমতায়। সেই অঙ্কেই ভুল ধরে কেউ বলছেন, সরকার গড়ছেন দিদিই। সব পার্টি অফিসই যেন এখন অঙ্কের পাঠশালা। ফলের আগে এমনই কয়েকটি পার্টি অফিসের কয়েকটি ছবি তুলে ধরলেন কিশোর সাহা।বালুরঘাট শহরের সাধনা মোড়ের আরএসপি অফিস বেশির ভাগ সময়ই জমজমাট। ওয়ার্ড স্তরের এক নেতার চিৎকার, ‘২ থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটের হিসাবটা মিলছে না যে!’ আরেকজন তাঁকে থামিয়ে চেঁচালেন, ‘‘ওটা বিশ্বনাথদার পক্ষেই যাবে রে।’’ পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘২১, ২২, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওই খবরটা কি ঠিক?

ভোটের আঁক কষতে ব্যস্ত কর্মীরা। সরগরম আরএসপি-র দলীয় দফতর।

ভোটের আঁক কষতে ব্যস্ত কর্মীরা। সরগরম আরএসপি-র দলীয় দফতর।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০১:৫৭
Share: Save:

দক্ষিণ দিনাজপুর

আলোচনায় অ্যান্টিবায়োটিক

বালুরঘাট শহরের সাধনা মোড়ের আরএসপি অফিস বেশির ভাগ সময়ই জমজমাট। ওয়ার্ড স্তরের এক নেতার চিৎকার, ‘২ থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটের হিসাবটা মিলছে না যে!’ আরেকজন তাঁকে থামিয়ে চেঁচালেন, ‘‘ওটা বিশ্বনাথদার পক্ষেই যাবে রে।’’ পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘২১, ২২, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওই খবরটা কি ঠিক? ওদের (তৃণমূল) গোষ্ঠী কোন্দলের লাভ ঘরে তুলতে পারব তো?’’ ঘর থেকে হাঁক, ‘‘জগা... দশ কাপ চা দে।’’ চায়ে চুমক দিয়ে মোবাইল খুলে এসএমএস দেখিয়ে একজনের বিবৃতি, ‘খিদিরপুর থেকে সাহেব কাছারি, চক ভবানী থেকে বেলতলা পার্ক, অনেক বুথেই অ্যান্টিবায়োটিক (কেন্দ্রীয় বাহিনীর তাড়া) খেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বিপক্ষ শিবিরের অনেককেই।’’ তাও কয়েক জন আবার হিসেব মিলছে না বলে দাবি করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘‘জোটের ওই নেতা তো মনে হচ্ছে ব্যাক গিয়ারে খেলেছেন। ব্যাটাচ্ছেলে তলে তলে জল খেয়ে আমাদের ডোবায়নি তো?’

কাটাছেঁড়ায় রক্তপাত

বালুরঘাটে ডানলপ মোড়ের কাছে কংগ্রেস পাড়া এলাকা। রাস্তার পাশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, পোশাক সামগ্রীর শো-রুম থেকে সারি সারি মনিহারি এবং সোনার দোকান। একটি বাণিজ্য ভবনের নীচতলার দোকানঘর নিয়েই চালু হয়েছে তৃণমূলের পার্টি অফিস। হাজার কথা ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে। বিপ্লব গোষ্ঠীর কোন ওয়ার্ড-নেতা বসে গিয়েছিলেন, তার কারণ নিয়ে চলছিল কাটাছেঁড়া। এক নেতা ক্ষেপে ওঠেন, ‘‘হিলিতে দলের নেতা বিরোধী জোটের তাঁবুতে বসেছিলেন, আমি দেখেছি। বলেছিলাম, পদ থেকে ওঁকে সরিয়ে দিন। সে সময় কেউ শুনলেন না।’’ বলে টেবিলের একটা কাগজ গোল্লা পাকিয়ে দেওয়ালে ছুঁড়ে দিলেন ওই নেতা। পরিস্থিতি তাতছে দেখে এক মাঝারি নেতা ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘হিসেব মেলা মুশকিল মশাই। হিলি থেকে হরিরামপুর—জেলার ৬টি আসনেই সক্রিয় ছিল দলের দু’পক্ষ। বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুরেও মোবিল ঢেলে আছাড় খাওয়ানোর চেষ্টা হয়েছে।’’

ঘরের মধ্যে তখন চেঁচামেচি। কারও গলায়, ‘অমুকের লোকজন ভেতর থেকে এমন করলো যে গঙ্গারামপুরে সত্যেনবাবু জেতা মুশকিল।’’ বর্ষীয়ান নেতা থামান। তাঁকে বলতে হয়, ‘আমরা কি নিজেরাই খাওয়া-খায়ি করে যদু বংশের মতো ধ্বংস হয়ে যাব নাকি রে?’’ সমস্বরে আওয়াজ ওঠে, ‘‘না না কোনও চিন্তা নেই। শঙ্করদা, বিপ্লবদা, সত্যেনদারা জিতছেনই। বালুরঘাট শহরে শঙ্করদার ৩ হাজার ভোট লিড থাকবে দেখে নিস।

উত্তর দিনাজপুর

অঙ্ক মেলাতে হিমসিম

মুখে মুখে হিসেব নিকেশ চলছে রায়গঞ্জের গীতাঞ্জলি সিনেমা হলের উল্টোদিকে সুপারমার্কেটের দোতলার উত্তর দিনাজপুর জেলা তৃণমূল কার্যালয়ে। একপক্ষের খাতা অনুযায়ী, তৃণমূলের দখলে জেলার যে চারটি আসন ছিল অর্থাৎ ইটাহার, ইসলামপুর, গোয়ালপোখর ও চোপড়া এবার ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। যুক্তি, মোদী হাওয়া নেই। তাই ইসলামপুরে বিজেপির ভোট জোটপ্রার্থী কংগ্রেসের কানাইয়ালাল অগ্রবালের পক্ষে পড়তে পারে। গোয়ালপোখরে জোটপ্রার্থী কংগ্রেসের মৌলানা আফজল ভাল লড়াই দিয়েছেন। তাই এবারে ইটাহার ও চোপড়া ছাড়া বাকি আসনগুলিতে তৃণমূলের জেতা প্রায় অসম্ভব।’

এ সব অঙ্ক জোলো ফর্মুলায় হয়েছে বলে দাবি তৃণমূলের প্রবীণ নেতার। যে চারটি বিধানসভা তৃণমূলের দখলে ছিল, সাংগঠনিক শক্তি বাড়ায় তা এবারেও দখলে থাকবে। ওই নেতার অঙ্কের সূত্র অনুযায়ী, হেমতাবাদ বিধানসভাতেও জোটপ্রার্থী সিপিএমের দেবেন রায়ের বিরুদ্ধে ভোটের আগে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ওই আসনটি এবারে তৃণমূলের দখলে যেতে পারে। করণদিঘি ও কালিয়াগঞ্জ আসনেও ‘পরিবর্তন’ হতে পারে বলে তৃণমূলের অঙ্ক বলছে। কিন্তু ভাবাচ্ছে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব। কাজেই অঙ্কের উত্তর ঠিকঠাক মেলা যে বড়ই মুশকিল সেটা মানছেন অনেকেই।

মনোবল তুঙ্গে

রায়গঞ্জ স্টেশন রোড। জেলা কংগ্রেসের নিজস্ব কার্যালয়। দোতলার ওই কার্যালয়ে একটি বড় সভাকক্ষ সহ ঘর রয়েছে চারটি। একটি ঘরে বসেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিতবাবু। সব প্রশ্নই নাকি কমন পড়েছে। তাই বাড়তি মনোবল ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘরের আনাচকানাচ। ৯টি আসনেই জোটপ্রার্থীরা জয়ী হবেন। অঙ্ক এখানে এতটাই সরল। দলের যুব সংগঠনের এক নেতার যুক্তি, ‘‘এবারে কংগ্রেস ও বামেদের জোটবদ্ধ লড়াই হয়েছে। নির্বাচনের দিন এই জোটই রুখে দিয়েছে তৃণমূলকে।’’ বিষয়টি ধাপে ধাপে বোঝান আরেক নেতা। ‘‘হেমতাবাদ, করণদিঘিতে তৃণমূলে তুমুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। রায়গঞ্জে তৃণমূলের সংগঠন নেই। ইসলামপুর, গোয়ালপোখর, চোপড়ায় বিদায়ী তৃণমূল বিধায়কদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নানা ক্ষোভ। তার উপরে এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হয়নি।’’

মালদহ

আপাতত কাঁচা আম

‘অধীর-অশোক’-এর ‘রোড শো’তে যতই ভিড় হোক না কেন, ‘দাদা’র জেতার অঙ্ক মিলিয়ে দিচ্ছেন প্রায় সব অনুগামীই। বলাই বাহুল্য, ইংরেজবাজারে ‘দাদা’ মানে মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। সেখানেই কালীতলার কাছে তাঁর দলীয় অফিসে এখন একটাই আলোচনা, পুরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে জবরদস্ত ‘লিড’ নেওয়াটা কতটা সম্ভব হবে। গ্রামাঞ্চলে আবার ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। এক নেতা শহর-গ্রামের বুথের হিসেব কষে শেষে ‘দাদা প্রায় ৫ হাজার ভোটে জিতবেন’ বলে রায় দিলেন। যা শুনে একজন চেঁচালেন, ধুর, আরও বেশি হবে। সে না হয় হল, সাবিত্রীদির কী হবে, বাবলাদা জিতবে তো? একজনের সমাধান, ‘‘ভূতনির সেতুর কাজ শুরু হওয়ায় সেখানে ভাল ভোটেই এগোবেন সাবিত্রী মিত্র।’’

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফস করে হিসেব দিলেন এক তৃণমূল নেতা, কিন্তু ভূতনি থেকে বার হয়ে সাবিত্রী দেবী যে অনেক এলাকায় পিছিয়ে পড়তে পারেন সেটা খেয়াল রাখতে হবে। ‘‘কেন? কেন?’’ কয়েকজন বিস্মিত। ফিসফাসে বোঝা গেল, এক নেতৃ স্থানীয়ের জামাইয়ের বিরুদ্ধে নাকি এলাকায় বিস্তর ক্ষোভ জমে রয়েছে। তা হলে মালদহের অঙ্কের মোট ফল কী বলছে? এক তৃণমূল নেতার মন্তব্য, ‘‘এখনও মালদহে আম পাকার সময় হয়নি। আপাতত কাঁচা আমের উপরেই থাকতে হবে।’’

‘একটা আসন মনে হয়’

প্রয়াত গনি খান চৌধুরীর দূর্গে এই প্রথম বামেরা বেশ স্বস্তিতে। কালীতলার সিপিএমের অফিসে প্রবীণ বাম নেতা চেয়ারে হেলান দিয়ে হিসেব দেন, ‘‘সেই আশির দশক থেকে গনি খানের সঙ্গে এঁটে ওঠা যায়নি। তিনি চলে যাওয়ার পরেও তাঁর ছায়ার সঙ্গে লড়ে কংগ্রেস বাজিমাত করেছে। এবার সেই গনি ম্যাজিক কাজে এসেছে বামেদেরও। জোটের সুবাদে।’’ তাই চেয়ারে এলিয়ে বসেই সামনে রাখা কাগজ যাতে লেখা ১১-০, এগিয়ে দেন সতীর্থদের দিকে। তা দেখে একজন শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেন, ‘‘দাদা ১টা আসন তো মনে হয়---এ টুকু বলার পরে চেয়ারে সোজা হয়ে বসেন ‘দাদা’। হাত তুলে সকলকে থামিয়ে টেবিলের কাগজটা দেখিয়ে মানিকচক, গাজল, চাঁচল, কালিয়াচক, ইংরেজবাজারের বুথওয়ারি হিসেব দিতে থাকেন, বোঝাতে থাকেন, সকলে বুঝতে থাকে। কিন্তু, নাছোড়বান্দা একজন বলতে থাকেন, ‘‘সবই বুঝলাম, কিন্তু, একটা আসন মনে হয়…..।’’

সরল অঙ্ক

লিফলেট, ফেস্টুন ছড়ানো। মুখে মুখে অঙ্ক কংগ্রেসের বিএস রোডের অফিসে। কোতুয়ালির বাড়ি থেকে কখনও-সখনও ডালুবাবু মানে আবু হাসেম খান চৌধুরীর ফোন আসছে। উৎসবের প্রস্তুতিও নাকি চলছে। জেলা স্তরের একাধিক নেতা মুখে মুখে যে সব অঙ্ক করছেন তাতে অবশ্য পিলে চমকে যাচ্ছে অনেকেরই। একে গনি ম্যাজিক, তার উপরে বামেদের শক্ত সংগঠন, মোদী হাওয়া ফিকে হয়ে যাওয়া, সঙ্গে তৃণমূলের নানা কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ জনতার একাংশ, সব মিলিয়ে ১০০ তে ১০০ পাওয়ার ভরপুর ইচ্ছে কংগ্রেসিদের।

(সহ প্রতিবেদন: অনুপরতন মোহান্ত, গৌর আচার্য ও অভিজিৎ সাহা)
বালুরঘাটে অমিত মোহান্তের তোলা ছবি।

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ সরাসরি: ‘মাছ ধরতে শেখানো উচিত’, আক্রমণ দেবজিতের

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 TMC RSP Vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE