Advertisement
E-Paper

আলো জ্বেলে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান রোশেনারা’রা

রাজবাড়িগুলির পুজোয় আনাচেকানাচে এখনও ঘুরে বেড়ায় অনেক গল্প। কোথাও সিংহাসন নিয়ে রাজা আসতেন দেবী বাড়িতে। কোথাও বিসর্জনে দু’মিনিটের পথ যেতে লাগে দু’ঘণ্টা। কোথাও আবার সম্প্রীতির আলো দিয়ে দেবীকে বিদায় জানান সংখ্যালঘুরা। লিখছেন অনিতা দত্তরাজবাড়িগুলির পুজোয় আনাচেকানাচে এখনও ঘুরে বেড়ায় অনেক গল্প। কোথাও সিংহাসন নিয়ে রাজা আসতেন দেবী বাড়িতে। কোথাও বিসর্জনে দু’মিনিটের পথ যেতে লাগে দু’ঘণ্টা। কোথাও আবার সম্প্রীতির আলো দিয়ে দেবীকে বিদায় জানান সংখ্যালঘুরা। লিখছেন অনিতা দত্ত।

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১০
জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে। —নিজস্ব চিত্র।

জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে। —নিজস্ব চিত্র।

চাঁচল রাজবাড়ি

হাতিশালে হাতি নেই, নেই ঘোড়াশালে ঘোড়াও। কিন্তু এক সময় চাঁচলের রাজারা হাতির পিঠে চেপে পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে যেতেন দেবী দর্শন করতে। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধর রায়চৌধুরীরা নীলকুঠীর দেওয়ান হিসেবে আসেন হরিশচন্দ্রপুরের শেখসাতন এলাকায়। নীল চাষ বন্ধ হলেও চাঁচলের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা থাকতে শুরু করেন। ১৯০৪-এ চাঁচল রাজবাড়িতে গৃহপ্রবেশের মধ্যে দিয়ে চাঁচলে তাঁদের বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়। রাজঠাকুরবাড়িতে নিত্যপূজা হয় সিংহবাহিনী অষ্টধাতুর মূর্তি। পুজো শুরু হয় কৃষ্ণা নবমী থেকেই। কৃষ্ণাকল্পারম্ভ হয়। সে দিন শোভাযাত্রা সহকারে সিংহবাহিনীকে নিয়ে আসা হয় পাহাড়পুর চণ্ডীমণ্ডপে। সিংহবাহিনীর সঙ্গে ফি বছর পূজিত হয় চতুর্ভুজা চণ্ডীর মৃন্ময়ী মূর্তি। কথিত আছে, চণ্ডীমণ্ডপ সংলগ্ন পুকুরটি পুজোর ক’দিন বলির রক্তে ভরে থাকত। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে দুর্গাপুজো বলতে ছিল চাঁচলের রাজবাড়ির এই পুজোটিই। বর্তমানে এলাকায় একাধিক বারোয়ারি পুজো হলেও এ পুজো ঘিরে এলাকাবাসীর আবেগ, উন্মাদনা একই রকম রয়ে গিয়েছ। চাঁচলের জমিদারদের আর একটি পুজো হয়ে আসছে মালতীপুরে। এই পুজোর বিসর্জনকে কেন্দ্র করে একটি অভিনব ঘটনা ঘটে। সূর্যাস্তের পূর্বে মহানন্দার পূর্ব পাড়ে যখন বিসর্জনের আয়োজন চলে, পশ্চিম পাড়ে সহুরগাছির রোশেনারা, অানোয়ারা বিবিরা চিরাচরিত প্রথা মেনে লন্ঠন জ্বালিয়ে দেবীকে বিদায় জানান। রাজ আমলের পুজো দু’টিই বর্তমানে চাঁচল রাজ ট্রাস্ট এস্টেটের অধীনে সম্পন্ন হয়।

জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি

জলপাইগুড়ির রায়কত রাজবংশের দেবী বন্দনা এ বার ৫০৭ বছরে পা দেবে। তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী প্রতিমা তৈরি হয় রথের মধ্যে। দেবী এখানে কনকদুর্গা রূপে পূজিত। সঙ্গে পূজা পায় যে সিংহটি, তার রং শ্বেতশুভ্র। রয়েছে তার দু’টি ডানা পূজিত হয় বাঘ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মহামায়ার সঙ্গে পুজো করা হয় দুর্গার দুই সখী জয়া ও বিজয়াকেও।

দেবীকে পরানো হয় কোনও বার আসল বেনারসী শাড়ি, কোনও বার অসম সিল্ক। এ বার খোদ অসম থেকেই নিয়ে আসা হচ্ছে ‘অফ হোয়াইট’ রঙের লাল পাড়ের শাড়ি। পঞ্চমীর দিন রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে দেবীকে সাজানোর জন্য পুরোহিতের হাতে তুলে দেওয়া হয় সোনার অলঙ্কার। চারুচন্দ্র সান্যালের ‘জলপাইগু়ড়ি শহরের একশো বছর’ প্রবন্ধে এই পুজোতেও নরবলির উল্লেখ রয়েছে। আজও অষ্টমীর ‘অর্ধরাত্রি’ পুজোয় চালের গুড়ি দিয়ে মণ্ড তৈরি করে প্রতীকী মানুষ বানিয়ে কুশ দিয়ে বলি দেওয়া হয়। এ সব জানা গেল প্রতিভাদেবীর কনিষ্ঠ পুত্র প্রণত বসুর কাছ থেকে।

রাজ পরিবারের প্রতিমা নিরঞ্জন পর্বটি রীতিমতো রাজকীয়। ছ’টি চাকা লাগানো রথে দেবী প্রস্থান করেন মন্দির থেকে। সেই সময় শূন্যে এক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মাকে বিদায় জানানো হয়। এই কাজটি করেন প্রণতবাবুর পুত্র সৌম্য বসু। রথে লাগানো রশি টানতে প্রায় চার, সাড়ে চার হাজারে মানুষের ভিড় হয়। মন্দিরের পিছনেই রয়েছে পুকুর। দু’মিনিটের পথ পার হতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। সামনে যায় রুপোর দণ্ডে লাগানো হলুদ রঙের রাজনিশান। তার পরে ঘট বা কলস। পাশে পাশে রাজপুরোহিতের বংশধরেরা বহন করে নিয়ে যান রুপোর রাজদণ্ড, রাজ আমলের রুপোর গদা ও খড়্গ। প্রতিমার দু’পাশে দু’জন ‘দেউরী’ রাজ আমলের ব্যবহৃত সুবৃহৎ পাখা নিয়ে মাকে বাতাস করতে থাকেন। নিরঞ্জন শেষে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে প্রজাস্বরূপ উপস্থিত আমজনতার প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় মিষ্টি।

কোচবিহার রাজবাড়ি

মহাষ্টমীর দিন রাজনগরের পথে প্রজাদের ঢল নামত। রাজার দর্শন মিলত বছরে মাত্র একবার। সেই মহাষ্টমীর দিন। এ দিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে হাতির পিঠে চড়ে দেবী বাড়ির পুজোয় আসতেন কোচবিহারের রাজাধিরাজ। সঙ্গে আসত রাজ সিংহাসন। দেবী বাড়ির রাজ সিংহাসনে বসে প্রজাদের মুখোমুখি হতেন কোচবিহারের রাজা।

সেই রাজাও নেই, রাজপাটও নেই। কিন্তু প্রথা রয়ে গিয়েছে। আজও অষ্টমীর অঞ্জলি প্রথামাফিক রাজপ্রতিনিধি হিসেবে প্রদান করে আসছেন দেবোত্তর ট্রাস্টের সভাপতি জেলাশাসক। তাঁর অঞ্জলি শেষ হলে তবেই আমজনতা অঞ্জলি দিতে পারেন। আজও অষ্টমীর ‘নিশাপূজা’ নররক্ত না হলে পূর্ণতা পায় না।

দেবোত্তর ট্রাস্টের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট (বড়বাবু) জয়ন্ত চক্রবর্তী জানালেন, পাঁচশো বছরের পুরানো এ পুজোর প্রস্তুতি চলে বছরভরই। ময়না কাঠ ছাড়া তৈরি হবে না মাতৃমূর্তি। কাঁটাযুক্ত এই গাছ জলাশয়ে মেলে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তার সন্ধান করতে হয়। এগারো ফুট লম্বা সেই কাঠ মন্দিরে নিয়ে আসা হয় পালকি করে। সেখানে পুজোপাঠ চলে, ময়না কাঠটিকে পরানো হয় কাপড়। সন্ধ্যায় পালকিতে করে বাজনা বাজিয়ে ‘দুয়ারবক্সী’ নিমন্ত্রণ করে কাঠ নিয়ে আসেন মদনমোহন বাড়িতে। সেখানে এক মাস পুজো করা হয় ময়না কাঠকে। রাধাষ্টমীর দিন সূর্য ওঠার আগে ভোর রাতে পালকি করে নিয়ে যাওয়া হয় দেবী বাড়িতে। সেখানে পাটে বা পাটাতনে স্থাপন করা হয় কাঠটিকে। কাঠের শরীর থেকে কাপড় সরিয়ে দু’দিন চলে ‘হাওয়া খাওয়া’ অনুষ্ঠান।

মায়ের মুখ আজও তৈরি হয়ে আসছে তুফানগঞ্জ মহকুমার চামটা গ্রামে মহারাজাদের নির্দিষ্ট জমির মাটি থেকে। কোচবিহারের কোচ রাজবংশের লোকাচারের ধারা এ ভাবে আজও বহমান।

Rajbari Durgapuja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy