Advertisement
০৩ মে ২০২৪

পরিকাঠামোর অভাবে জোড়া গেল না হাত

গত বুধবার রাতে দুর্ঘটনায় ট্রাকের ধাক্কায় ডান হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন সুকুমার বর্মনের। জখম রোগী এবং তাঁর কাটা হাত নিয়ে পরিবারের লোকেরা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই। কিন্তু সেখানে পরিকাঠামো না থাকায় সেই হাত জোড়া লাগানো যায়নি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

গত বুধবার রাতে দুর্ঘটনায় ট্রাকের ধাক্কায় ডান হাত কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন সুকুমার বর্মনের। জখম রোগী এবং তাঁর কাটা হাত নিয়ে পরিবারের লোকেরা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই। কিন্তু সেখানে পরিকাঠামো না থাকায় সেই হাত জোড়া লাগানো যায়নি। এমনকী পরিকাঠামো নেই বলে কাটা হাতের অংশটিও চিকিৎসকেরা নিতে চাননি বলে অভিযোগ রোগীর লোকদের। তাই আফশোস করছেন সুকুমার এবং তাঁর পরিবার। পেশায় পিকআপ ভ্যানের চালক সুকুমার প্রাণে বাঁচলেও ডান হাত পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় আর গাড়ি চালাতে পারবেন না ভেবেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

রাতেই ঘটনার খবর পেয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এবং বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হন শিলিগুড়ির সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। কিন্তু পরিকাঠামো না-থাকায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে হাতটি জোড়া লাগানো সম্ভব না হওয়ায় তিনি এখানকার স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো নিয়ে হতাশ। ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার রাজীব প্রসাদ। তাঁর কাছেও ফোন করে বিষয়টি দেখার অনুরোধ করেন সাংসদ। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, কাটা হাত ঠিক সময় তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি। সাংসদ এবং রোগীর পরিবারের অভিযোগ, শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া হাতের অংশটি চিকিৎসকেরা নিতেই চাননি।

রাজীববাবু বলেন, ‘‘ওই হাত আমাদের কাছে সময় মতো আনা হয়নি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা হাতের ওই অংশ পাননি। তা ছাড়া দেহ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হযে যাওয়া ওই হাত জুড়তে হলে ভ্যাসকুলার সার্জেন থাকা দরকার। এই হাসপাতালের ওই ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই।’’

বস্তুত, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাটা হাত জোড়া লাগানোর পরিকাঠামো যে নেই, তা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজীববাবুও। উত্তরবঙ্গে কোনও সরকারি হাসপাতালে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি বলে জানান চিকিৎসকদের অনেকেই। শিলিগুড়িতে হাতে গোনা কয়েকটি নার্সিংহোমে সেই পরিকাঠামো রয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজে সেই পরিকাঠামো রয়েছে। নার্সিংহোমে ওই অস্ত্রোপচার করতে খরচ কয়েক লক্ষ টাকা। সুকুমারবাবুর পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিল না নার্সিংহোমে মোটা টাকা খরচ করে ওই হাত জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করা। সাংসদ বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতো জায়গায় এ ধরনের পরিকাঠামো থাকা বিশেষ জরুরি। কেন সেই ব্যবস্থা এখানে এখনও হল না? আমি নিজে ওই দিন রাতে বারবার ফোন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু কী করা যাবে সেটাও তাঁরা জানাননি।’’ সাংসদের ক্ষোভ, প্রথমে জানানো হয় হাতের কাটা অংশটি হাসপাতালে আনা হয়নি। খোঁজখবর করে জানা গেল তা রোগীর সঙ্গেই রয়েছে। এ সব করতেই সময় নষ্ট হয়। নার্সিংহোমে এর পর খোঁজ করতে গেলে জানানো হয় ছয় ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ায় হাতের ওই অংশ জোড়া লাগানো যাবে না। না হলে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার করে কিছু না জানিয়ে সময় নষ্ট করাতেই সমস্যা বেড়েছে।

বাইশ বছরের সুকুমারের বাড়ি খড়িবাড়ির ভালুকগাড়াতে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতে পিকআপ ভ্যান চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। খাড়িবাড়ি বয়েজ হাই স্কুলের সামনে উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রাক আরেকটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে সুকুমারের গাড়ির একাংশে ধাক্কা মারে। সে সময় হাত বাইরে বার করায় কনুয়ের নীচে থেকে তাঁর ডান হাতটি কেটে রাস্তায় পড়ে যায়। তাঁর পাশে বসে ছিলেন বন্ধু বাসুদেব সরকার। সুকুমার ওই অবস্থায় এক হাত দিয়েই গাড়ি কোনও ক্রমে চালিয়ে ৩০০ মিটার দূরে খড়িবাড়ি হাসপাতালে পৌঁছন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থল থেকে হাতটি কুড়িয়ে নিয়ে আসেন বাসুদেববাবু। খড়িবাড়ি হাসপাতালের তরফে সেই হাত মেডিক্যালে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। রাত ১০ টার মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে যান উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে।

সুকুমারের দাদা পবিত্রবাবুর দাবি, ‘‘ঘটনার পর ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা খড়িবাড়ি হাসপাতালে পৌঁছই। সেখান থেকে দেড়, দুই ঘন্টার মধ্যেই মেডিক্যালে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসকদের একাংশ জানান, এখানে ব্যবস্থা না থাকার জন্য কাটা হাত জোড়া লাগানো যাবে না। আমাদের পক্ষে নার্সিংহোমে গিয়ে মোটা টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়।’’ তিনি জানান, কাটা হাত চিকিৎসকেরা নিতে চাননি। স্বাস্থ্যকর্মীদের কয়েকজন হাতের অংশটি রোগীর লোকদের রাখতে বললে শয‌্যার কাছে রাখা হয়। কিন্তু সেটাতে কাজ হবে না জানালে একদিন পর চিকিৎসকের পরামর্শে ফেলে দেওয়া হয়।

হাসপাতালের শল্য বিভাগের চিকিৎসক জিষ্ণু বসুনীয়া জানান, এ ধরনের ঘটনায় কাটা হাত বা অঙ্গটিকে স্যালাইনের দ্রবণে ডুবিয়ে নিযে যেতে হয়। ছ’ঘন্টার মধ্যেই সেটি জোড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসা ব্যবস্থা দরকার। সেই সঙ্গে ভাসকুলার সার্জেন প্রয়োজন। তাঁদের সঙ্গে অর্থোপেডিক এবং জেনারেল সার্জেনদের নিয়ে একটি টিম থাকবে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে। হাতের নার্ভ, সূক্ষ্ম শিরা জোড়া দেওয়ার জন্য দরকার হয় উন্নত মাইক্রোসকোপের। ওই ধরনের অস্ত্রোপচার করতেও অনেক ক্ষেত্রে সময় লাগে। ট্রমা কেয়ার সেন্টারে সাধারণত এ ধরনের ব্যবস্থা থাকে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ওই পরিকাঠামো এখনও চালুই হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Patient Doctor Medical collage hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE