Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ফাগুয়া পরবেই বছর শেষের পালা

‘‘বসরপিদান দিনোয়াই  বাসমাতানি হাফাগায়’’  বসন্তের এই দিনে আমরা ধরার বুকে নৃত্যগীত করি।  বসন্তের এমন আবাহন সংগীত গেয়ে রাভা সম্প্রদায়ের মানুষ দোলের দু’এক দিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে  মাঙন তোলেন।

অনিতা দত্ত
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৮ ০২:৩৯
Share: Save:

দোলের উৎসবে উত্তরবঙ্গে কোথাও হয় ধলুয়া রাজার পুজো, কোথাও বসে হুলিগানের আসর। কোনও জনজাতির মানুষ মেতে ওঠেন বসন্তের আবাহনগীতে। আবার ওরাওঁ সমাজে ফাগুয়া পরব মানেই বছর শেষের পালা, নতুন বছরের সূচনা।

‘‘বসরপিদান দিনোয়াই বাসমাতানি হাফাগায়’’ বসন্তের এই দিনে আমরা ধরার বুকে নৃত্যগীত করি। বসন্তের এমন আবাহন সংগীত গেয়ে রাভা সম্প্রদায়ের মানুষ দোলের দু’এক দিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাঙন তোলেন। এই ছবিটি এখন ও দেখতে পাওয়া যায় কুমারগ্রাম ব্লকের পূর্বশালবাড়িতে জানালেন লোকসংস্কৃতি কর্মী সুশীল রাভা। রাভাদের দোলযাত্রা শুরু হয় গৃহদেবতা ‘রন্তুক’কে আবির ছুঁয়ে। নিবেদন করা হয় চকত (মদ)। এ দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যেও চকত নিবেদনের প্রথা চালু রয়েছে। রাভা ভাষায় এই রীতির নাম ‘জৌরাকাল’ (প্রেতাত্মার প্রতি নিবেদন)। অানুষ্ঠানিক এই পর্ব মিটলে রাভা সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে ওঠেন রঙের উৎসবে। মাঙন করে যে চাল সংগ্রহ করা হয় তা দিয়ে তৈরি চকত দোলের পর্ব শেষে ‘রন্তুক’ ও পূর্বপুরুষদের নিবেদন করে চলে ভোজের প্রস্তুতি।

আবার দোলকে কেন্দ্র করে তরাই ও ডুয়ার্সে রাজবংশী সমাজে এক সময় ‘ধুলিয়া রাজার বিচার’ বা ‘ধুলিয়া রাজার পুজো’ প্রচলিত ছিল। গ্রামেরই কেউ রাজা, মন্ত্রী কেউ বা সেনাপতি সাজতেন। গ্রামবাসীরা একে একে এসে তাঁদের ‘অন্যায় অপরাধ’ কবুল করতেন। দোলকে কেন্দ্র করে এমন সামাজিক প্রথাগত আইন বা বিচার ব্যবস্থার রূপ দেখা যেত। এখন ও তরাইয়ের ফাঁসিদেওয়া, খড়িবাড়ি অঞ্চলে এই ধুলিয়ার রাজার বিচার সভা বা ধুলিয়া রাজার পুজো অনুষ্ঠিত হয়। তবে আজ আর বিচারসভা বসে না। রাজার সামনে পরিবেশিত হয় নৃত্যগীত। কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের উছলপুকুরি গ্রামে এই ধুলিয়া রাজার পুজো হয়ে আসছে। শোলা বা মাটি দিয়ে তৈরি ঘোড়ার উপর বসা রাজা ও রানি পুজো পেয়ে থাকেন। অধ্যাপক দীপককুমার রায়ের মতে, এর মধ্যে নিহিত আছে রাজবংশী সমাজের ঐতিহ্য, আছে মূল্যবোধের বিষয়টিও। দোলের দিন রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ ‘হুলি গান’-এর আসর বসান ‘দোলাবাড়ি’-তে বা লোকালয় থেকে খানিক দূরে বসে এই গানের আসর। গানের অশ্লীল শব্দ ব্যবহৃত হয়। দীপককুমার রায় জানান, শিবকে সামনে রেখে উর্বরতার কামনা বাসনা এই গানের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে। এই গানে অনেক জায়গায় ‘পালা’ আছে। তাকে বলা হয় হুলি গানের পালা। তিনি জানালেন এক সময় গায়ক বাদকেরা উলঙ্গ হয়ে এই গান পরিবেশন করতেন। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

আমাদের কাছে যা দোল ওরাওঁ সমাজে তা ফাগুয়া পরব নামেই পরিচিত। দোলের পরদিন এই উৎসবে মেতে ওঠেন ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের বছর শেষও হয় এই পরবের দিনই। পর দিন থেকেই শুরু হয় নতুন বছর। এই পার্বণে ওরাঁও সমাজে ‘সেন্দ্রা খেলা’-র প্রচলন রয়েছে। কুরুখ ভাষায় ‘ সেন্দ্রা’ শব্দের অর্থ শিকার। তাদের কাছে ফাগুন মাস শিকারের মাস। এই শিকারেরও রকমফের আছে। ফাগু সেন্দ্রা (পশু শিকার), ইঞ্জো সেন্দ্রা (মাছ শিকার), উড়া সেন্দ্রা (পাখি শিকার)। শিকার শেষে বাড়ি ফিরে এই মাংস বিলি করা হয়। শিকারের মাংস একমাত্র পুরুষেরাই খেতে পারবেন।

স্বাধীনতার পর পর ওরাওঁ সমাজে সেন্দ্রা খেলা হত। পরবর্তীতে পশু শিকার নিষিদ্ধ হবার ফলে এই প্রথাটি প্রায় উঠে গেছে বলে জানান অখিল ভারতীয় আদিবাসী পরিষদের সহ সভাপতি তেজকুমার টোপ্পো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fagua Festival North Bengal Holi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE