Advertisement
০৭ মে ২০২৪

খুঁচিয়ে সিলিন্ডার পরীক্ষায় ভ্যানচালক, পুড়ে জখম দুই

নতুন সিলিন্ডার লাগানোর পরেও ওভেন জ্বলছে না বলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন গৃহকর্তা। তা শুনে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে আসেন এক ভ্যানচালক। তিনিই ভ্যানে করে সিলিন্ডার পৌঁছে দেন বাড়ি বাড়ি।

সিলিন্ডার ফাটার ঘটনার পর পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

সিলিন্ডার ফাটার ঘটনার পর পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০২:০৮
Share: Save:

নতুন সিলিন্ডার লাগানোর পরেও ওভেন জ্বলছে না বলে অভিযোগ জানিয়েছিলেন গৃহকর্তা। তা শুনে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে আসেন এক ভ্যানচালক। তিনিই ভ্যানে করে সিলিন্ডার পৌঁছে দেন বাড়ি বাড়ি। সিলিন্ডারের ভালভে বেশ কিছুক্ষণ খুঁচিয়ে, গ্যাস বের হচ্ছে কি না পরীক্ষা করে, দেশলাই কাঠি জ্বালান তিনি। মুহূর্তে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গৃহকর্তা এবং ভ্যানচালক দু’জনেই জখম হয়েছেন। গৃহকর্তাকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও, জখম গুরুতর হওয়ায় ভ্যানচালককে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছে।

শুক্রবার সকালে শিলিগুড়ির ডাবগ্রামের এই ঘটনার পরে শিউরে উঠছেন গৃহকর্তা এবং ভ্যানচালকের পরিবারের সদস্যরা। এই ঘটনা তুলে দিয়েছে একাধিক প্রশ্নও। সরবারহের আগে প্রতিটি সিলিন্ডার পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও, কী ভাবে গৃহস্থের বাড়িতে ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার সরবরাহ হল? সিলিন্ডারে ত্রুটির অভিযোগ পেয়ে ভ্যানচালককে কেন পরীক্ষা করতে করতে পাঠানো হল, সে প্রশ্নও উঠেছে। সিলিন্ডার পরীক্ষার যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকাতেই এ দিনের দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। তার দায় কার, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ডাবগ্রাম এলাকার বাসিন্দারা।

বাসিন্দাদের দাবি, গত বৃহস্পতিবার নারায়ণ দাসের বাড়িতে সিলিন্ডার পৌঁছে দেন ভ্যানচালক সহদেব বর্মন। সিলিন্ডার ওভেনে লাগানো হলেও, তা না জ্বলায় সহদেববাবুকেই ফোন করেন নারায়ণবাবু। পরিবারের সদস্যদের দাবি, আগেও একাধিকবার এমন ত্রুটি পেয়ে সরবরাহকারী এজেন্সিকে অভিযোগ জানানো হয়েছিল। প্রতিবারই এজেন্সি থেকে ভ্যানচালকের মোবাইল নম্বর দিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সে সুবাদে নারায়ণবাবুর কাছে সহদেববাবুর মোবাইল নম্বর আগেই ছিল। এ দিনও সিলিন্ডারে ত্রুটি রয়েছে বুঝতে পেরে সহদেববাবুকেই তাই ফোন করা হয় পরিবারের তরফে। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, সিলিন্ডারে ত্রুটির মতো একটি বিপজ্জনক বিষয় পরীক্ষার জন্য কেন ভ্যানচালককে পাঠানো হবে?

ক্ষতিগ্রস্ত সিলিন্ডারটি যে সংস্থার তারা জানিয়েছে, যে এজেন্সি গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করে, তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী রাখার কথা। কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে সেই কর্মীকেই পাঠানোর কথা। ভ্যানচালক বা সরবরাহকারীর শুধু সিলিন্ডারের ওজন পরীক্ষা করে দেখানোর কথা।

এ দিনের ঘটনার পরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তরফে কোনও অভিযোগ করা হয়নি। পরিবারের এক সদস্যদের দাবি, গ্যাস এজেন্সির তরফে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই অভিযোগ করা হয়নি। অভিযোগ হলে ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এত গাফিলতি সামনে আসার পরে পুলিশের পদক্ষেপ করা উচিত ছিল। কোনও বাড়িতে আগুন লেগে পুলিশ নিজে থেকেই তদন্ত করে। এ ক্ষেত্রে তা কেন হল না, সে প্রশ্ন বাসিন্দাদের। গাফিলতি ধামাচাপা দিতে একটি প্রভাবশালী মহল সক্রিয় হয়েছে বলেও আশঙ্কা কয়েকজনের। সে কারণেই পুলিশের তরফে পদক্ষেপ হয়নি বলে অভিযোগ। এমনকী বাসিন্দাদের কয়েকজন শিলিগুড়ি থানায় আগুন লাগার অভিযোগ জানিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট থানা নিজেরাই মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে পারত। কেন তা হল না, তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ বিস্মিত কমিশনার বলেন, ‘‘দুর্ঘটনায় কোনও মৃত্যু হলে তবেই মামলা করা যাবে এমন কথা নেই। কেউ জখম হলে, অথবা জিনিসপত্র নষ্ট হলেই মামলা করা যায়।’’

নারায়ণবাবুরা শিলিগুড়ির কলেজ পাড়ার একটি এজেন্সির গ্রাহক। সেই এজেন্সির কর্ণধার কৌশিক সরকার জখমদের চিকিৎসার বিষয়ে সম্পূর্ণ সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে রাত পর্যন্ত জখম নারায়ণবাবু ও সহদেববাবুর পরিবারের সদস্যরা কোনও সাহায্য পাননি বলে দাবি করেছেন। নারায়ণবাবুর বড় মেয়ে চোদ্দ বছরের দোলন বলে, ‘‘সিলিন্ডারের মুখে বেশ কিছু ক্ষণ একটি কলম দিয়ে খোঁচাখুচি করেন ভ্যানচালক। তারপরে দেশলাই জ্বালাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের ফ্রিজ, সোফা পুড়ে যায়।’’ আগুন লাগার পরে জখম অবস্থাতেই সহদেববাবু সিলিন্ডারটি বাইরে বার করে আনেন। সে কারণে বড় ক্ষতি এড়ানো গিয়েছে বলে দাবি। নারায়ণবাবুদের দরমা বেড়ার ঘর। আর কয়েক মুহূর্ত সিলিন্ডার ঘরের ভিতরে থাকলে পুরো বাড়ি ছাই হয়ে যেত বলে আশঙ্কা পড়শিদের। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, আপাতত তাঁদের দু’জনের অবস্থাই স্থিতিশীল। জখম নারায়ণবাবুর ভাই মাধববাবু বলেন, ‘‘প্রথম ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার কেন সরবরাহ করা হল, তারপর সেটা ঠিক করার জন্য ভ্যান চালককে কেন পাঠানো হল, এই প্রশ্নের জবাব চাই। আমাদের পরিবার খুব একটা সচ্ছল নয়। এজেন্সির পক্ষ থেকে সমস্ত চিকিৎসার খরচ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। অভিযোগ করলে কী যে হবে জানি না।’’

এ দিকে দুর্ঘটনার দায় কার, তা নিয়ে শুরু হয়েছে দায় ঠেলাঠেলি। সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী সংস্থার ম্যানেজার গৌরব পাল সিংহ বলেন, ‘‘সিলিন্ডার ঠিক রয়েছে কি না তা বটলিং প্লান্ট, এজেন্সির পরীক্ষা করার কথায়। গ্রাহকদেরও সর্তক থাকতে হয়।’’ যদিও, এজেন্সির কর্ণধার কৌশিকবাবু বলেন, ‘সিলিন্ডার প্রস্তুতকারক সংস্থারই সিলিন্ডার পরীক্ষা করে দেওয়ার নিয়ম। তবু আমাদের কেউ ফোন করলে আমরা বিশেষজ্ঞ লোকই পাঠাই। অনেকে বাইরে থেকেও লোক ডেকে সারিয়ে নেন। তাঁদের দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে যাঁরা ডেলিভারির কাজ করেন, তাঁদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ থাকে।’’ তবে গ্রাহকদের একাংশের অভিযোগ, গ্যাসে ত্রুটির কথা জানালে ভ্যানচালকই পরীক্ষা করতে আসেন।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের আইনজীবী রতন বনিক বলেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনায় পরিষেবায় ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠতেই পারে। এমন অনেক অভিযোগ নিয়ে গ্রাহকরা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন। পুলিশ নিজেরাও সাধারণ দুর্ঘটনার মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gas cylinder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE