Advertisement
১৮ মে ২০২৪

হাসপাতালে ‘ডিউ স্লিপ’

কারও এক্স-রে হল না। কেউ দিনভর দোকানে দোকানে ঘুরেও পেলেন না ওষুধ। সরকারি নির্দেশ ছিল, হাসপাতাল-নার্সিংহোমে পাঁচশো ও হাজারের নোট নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ছিল ঠিক উল্টো। দিনভর হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও মাথা অসহায় দৌড় দেখা গেল রোগীর পরিজনদের।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৮
Share: Save:

কারও এক্স-রে হল না। কেউ দিনভর দোকানে দোকানে ঘুরেও পেলেন না ওষুধ। সরকারি নির্দেশ ছিল, হাসপাতাল-নার্সিংহোমে পাঁচশো ও হাজারের নোট নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ছিল ঠিক উল্টো। দিনভর হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও মাথা অসহায় দৌড় দেখা গেল রোগীর পরিজনদের। পকেটে টাকা রয়েছে, কিন্তু সবই পাঁচশো বা হাজারের নোট। তাই উত্তরবঙ্গের হাসপাতাল-নার্সিংহোমে বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুই দুর্ভোগের ছবি। কোনও হাসপাতালের ন্যায্য মূলের দোকানে পাঁচশো-হাজারের নোট দেখে সাফ না করে দেওয়াও হয়েছে।

কোচবিহারের হাসপাতাল থেকে রোগীদের ‘ডিউ স্লিপ’ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এ দিন। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনায় আওতাধীন রোগীর ছুটি হলে নগদ তিনশো টাকা করে দেওয়া হয়। কোচবিহার জেলা হাসপাতাল থেকে এ দিন ছয় জনের ছুটি হয়। টাকা নিতে তাঁদের পরে আসতে বলা হয়, হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় টাকার অঙ্ক লেখা কাগজের চিরকুট। রায়গঞ্জ হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগেও সকালে পাঁচশো-হাজারের নোট নিতে অস্বীকার করে বলে অভিযোগ। পরে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি আছেন সরকারি কর্মী গোপাল সরকার। শিলিগুড়ির মিলনপল্লির বাসিন্দা। এ দিন সকালে তাঁর স্ত্রী অঞ্জলিদেবী ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে গিয়েছিলেন। পাঁচশো টাকার নোট দিতেই দোকান থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। অঞ্জলিদেবীর দাবি, ‘‘আমাকে বলা হল খুচরো নেই। যদিও আমি বুঝতেই পারলাম, সত্যি বলা হচ্ছে না।’’ ওষুধ ছাড়া চলবে না, সে কারণে বাধ্য হয়ে মেডিক্যাল কলেজের বাইরে একটি দোকানে গিয়ে বেশি দাম দিয়ে ওষুধ কিনতে হয়েছে তাঁকে। তবে বাইরের দোকান থেকেও ওষুধ পাননি স্মরণজিত সিংহ। কোমরের হাড়ে রোগ সংক্রমণ নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি। একটি দামি ইঞ্জেকশন কিনতে গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁর ছেলে পরমকে। অভিযোগ, হাজার টাকার নোট নিতে চাননি ওষুধের দোকান। পরম কথায়, ‘‘সকালে ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাজার টাকার নোট নিল না কোনও দোকানে। একদিন ইঞ্জেকশন ছাড়াই থাকতে হবে বাবাকে।’’ কয়েক’শ কিলোমিটার দূরের মালদহ মেডিক্যাল কলেজে শুধুমাত্র পাঁচশো টাকার নোট রয়েছে বলে সদ্যোজাত শিশুর এক্স-রেই হল না দিনভর। সকাল থেকে দুপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগের সামনে সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল পুরাতন মালদহের মাধাইপুরের নিরঞ্জন রামকে। এক্সরে করাতে প্রয়োজন সাড়ে তিনশো টাকা। তবে নিরঞ্জনের কাছে রয়েছে ৫০০ টাকার নোট। কাউন্টারে ৫০০ টাকার নোট নিতে চাওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, প্যাথোলজি বিভাগ, এক্স রে বিভাগে লম্বা লাইন রোগীদের। সবক্ষেত্রেই ‘খুচরো নেই’ বলে নোট এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানের এক বিক্রেতা অবশ্য বলেন, ‘‘টাকা নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু খুচরো দেব কী করে। এত একশ টাকার নোট কোথায় পাব!’’

জলপাইগুড়ির অরবিন্দনগরের বাসিন্দা চন্দন দে ওষুধের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের আশেপাশে থাকা অন্তত পঞ্চাশটি ওষুধের দোকান ঘুরে ফেলেছেন। জোগাড় করতে পারেননি ওষুধ। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাবা নিরঞ্জনবাবু জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি। “খুব অসহায় লাগছে। টাকা আছে, কিন্তু ওষুধ পাচ্ছি না। ন্যায্যমূলের দোকান থেকেও ফিরে আসতে হল। জলপাইগুড়ি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকানের সামনে রোগীর আত্মীয়রা বিক্ষোভও দেখান। তারপরে পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়া হলেও, বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে কাগজে চিরকুট লিখে দেওয়া হয়েছে। তাতেও সমস্যায় পড়েছেন রোগীর পরিজনেরা। অনিতা বর্মনের রিকশা চালক স্বামী হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, ‘‘একটাই হাজার টাকার নোট ছিল। ওষুধ কেনার পরে টাকা ফেরত না দিলে, খাবার টাকা পাব কোথায়?’’ মালদহ শহরের এক নার্সিংহোমে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রফিজ উদ্দিনের এ দিন ছুটি হলেও, তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেননি মেয়ে সামিমা। নার্সিংহোমের বিল ১৬ হাজার টাকা তাঁর কাছে রয়েছে, কিন্তু সবই পাঁচশো হাজারের নোটে। সামিমা বলেন, ‘‘নার্সিংহোম কিছুতেই এ সব নোট নিতে চাইছে না। বাবার ছুটি হলেও বাড়ি ফিরতে পারল না। আগামীকাল অন্য নোট জোগাড় করতে পারব কি না তাও জানি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government hospitals
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE